ভূপতি ভূষণ বর্মার লোকশিল্প সংগ্রহশালা

আব্দুল খালেক ফারুক:
কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কের ধারে পাঁচপীর বাজার। বাজারের প্রবেশ মুখেই ভূপতি ভূষণ বর্মার ভাওয়াইয়া একাডেমী। এই একাডেমীর ঘরের ভেতর ও বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৭ শতাধিক বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানান সামগ্রী। ভূপতি ভূষণ বর্মা এর নাম দিয়েছেন ‘কছিমুদ্দিন লোকশিল্প সংগ্রহশালা’। কছিমুদ্দিনকে বলা হয় ‘ভাওয়াইয়া যুবরাজ’। কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহনকারী এই প্রয়াত ভাওয়াইয়া শিল্পীর রয়েছে বিপুল জনপ্রিয়তা।

যেভাবে শুরু
ভূপতি ভূষণ বর্মা শুধু একজন জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া শিল্পীই নন, ভাওয়াইয়া গানের পৃষ্ঠপোষক ও সংগঠক। সম্প্রতি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেছেন। বছরে একাধিকবার ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ যান- বিভিন্ন লোকসংগীত উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে। এভাবে ভাওয়াইয়ার সুরধবনি পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন দেশের গন্ডি পেরিয়ে দূর দেশে। ভক্তরা তার নামের সাথে জুড়ে দিয়েছেন ‘ভাওয়াইয়া ভাস্কর’ উপাধি। তিনি ভাওয়াইয়া গানকে উজ্জীবিত করতে নিজ প্রচেষ্টায় কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুরে স্থানীয় মহৎ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন করেন বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমি। বর্তমানে তিনি একাডেমির পরিচালক হিসাবে আছেন প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই। এই একাডেমির সূচনালগ্ন থেকে প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী তালিম নিয়েছেন ভাওয়াইয়া গানে। আর অনেকেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের তালিকায়। তিনি ভাওয়াইয়া গানের প্রচার, গবেষণা, আঞ্চলিক ভাষা রক্ষা, ইতিহাস- ঐতিহ্য তুলে ধরতে প্রকাশ করেছেন ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘ভাওয়াইয়ালোক’। যা বর্তমান দুই বাংলার পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত।


বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ বেতারের বিশেষ গ্রেডের শিল্পী ছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত শিল্পী। তার কন্ঠে রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কয়েকটি ভাওয়াইয়া গানের এ্যালবাম। এসবের মাঝে তাঁর অন্য রকম এক স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছে ‘কছিমুদ্দিন লোকসংগীত সংগ্রহশালা’র মাধ্যমে। কেন এই অনন্য উদ্যোগ সে বিষয়ে তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন নিজেই।

সংগ্রহ অভিযান যেভাবে
ভূপতি ভূষণ বর্মা জানান, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে কৃষি, ঘরগৃস্থালি, পেশাগত উপকরণ ও যানবাহন। আধুনিক নানান উপকরণের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পুরোনো ঐতিহ্য। উত্তরের কৃষিপ্রধান এই জনপদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক লোকশিল্প সামগ্রী। ভাওয়াইয়া গানের সাথে রয়েছে এসব সামগ্রীর গভীর সম্পর্ক। এসব বিলুপ্ত ও বিলুপ্ত প্রায় সামগ্রী সংগ্রহ করে তা নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করে ঐতিহ্যের লালন করাই এই সংগ্রহশালার উদ্দেশ্য-জানালেন ভূপতি ভূষণ বর্মা। তিনি জানান, গত ৪ চার বছর ধরে ধীরে ধীরে সংগ্রহ করা হচ্ছে এসব সামগ্রী। তবে গত বছরের আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় কছিমুদ্দিন লোকশিল্প সংগ্রহশালা। তারপর থেকে ভূপতি ভূষণ বর্মা হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের সন্ধানে ছুটে গেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে সভা করেছেন। উদ্বুদ্ধ করেছেন সবাইকে। এছাড়াও বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে ২৫টির মতো খুলি বৈঠক করেছেন। মৎস্যজীবী ও কৃষকসহ পেশাজীবীদের সাথে কথা বলে তাদের কাছে থাকা পুরোনো সামগ্রী সংগ্রহ করেছেন। সংগ্রহশালায় সংরক্ষণের কথা শুনে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিনে পয়সায় এসব সামগ্রী পাওয়া গেলেও কোন কোন ক্ষেত্রে অর্থ বা পণ্য বিনিময় করে সংগ্রহ করা হয়েছে উপকরণ। দুর্লভ উপকরণ সংগ্রহের জন্য ছুটে যেতে হয়েছে জেলার বাইবে। এখন গরুর গাড়িতে টায়ারের চাকা সংযোজন করা হলেও লোহার পাতযুক্ত কাঠের চাকা সংগ্রহ করা হয়েছে পঞ্চগড় থেকে। তিনি জানান, দুর্লভ জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে পারলে অনেক আনন্দ পান। হারানো সামগ্রী সংগ্রহের কাজে একাডেমীর ৬০ জন সদস্য ছাড়াও ৭ সদস্য বিশিষ্ট সংগ্রহ কমিটির সদস্যরা সহযোগিতা করছেন ভূপতি ভূষণ বর্মাকে।

সংগৃহিত সামগ্রী
কুছিমুদ্দিন লোকশিল্প সংগ্রহশালায় রয়েছে কয়েকটি ক্যাটাগরির সামগ্রী। এর মধ্যে অনেক দুর্লভ সামগ্রী রয়েছে সংগ্রহের তালিকায়। গৃহস্থালি ও মানুষের ব্যবহৃত সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে-কূপিবাতি, গছা (কূপি রাখার যন্ত্র), হ্যাজাক, কাঠের খরম, লাউয়ের বস, অতি প্রাচীন বদনা, বক মারার ফাঁদ, হুক্কা, ঢেঁকি, উরুন-গাইন। মাছ ধরার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে খোঁচা, বাগা, ডারকি,জিনা, টোসা, পেষ্টি, মহিষের সিংগা, চাক, ভাইর ইত্যাদী । কৃষিকাজে ব্যবহৃত কুশ্মি, কারাইল, টাকরুল, ঝাঁপি, জোয়াল, লাঙ্গল, ছেঁউতি, পাঠ, হাত নেংলা, খন্তি, কোদাল, কাঁচি, বাঁশের তৈরী ইঁদুর মারার কল রয়েছে এখানে। বিলুপ্তপ্রায় বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। এর মধ্যে রয়েছে খমক, খঞ্জনি, একতারা, দোতরা, মুগা বাঁশি, সারিন্দা। সৌখিন সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ফুলের সাজি, টুপি, ক্যামেরা। খেলনা সামগ্রীর মধ্যে বাটুল, লাটিম, খুটি মালাই আর পূজা পার্বণের সামগ্রীর মধ্যে শঙ্ক, কোশাকুশি, পঞ্চ প্রদীপ, চামর ইত্যাদী শোভাবর্ধন করছে সংগ্রহশালাটির।

লক্ষ্য বহুদূর
ভূপতি ভূষণ বর্মা জানান, প্রাচীন, অতি প্রাচীন ও দুর্লভ সামগ্রী সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। স্বপ্ন দেখেন এক সময় সংগ্রহিত সামগ্রীর সংখ্যা হবে কয়েক হাজার। লক্ষ্য রয়েছে কলের গান, করকা, সানাইসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র এবং মাটি, পাথর, পিতল ও কাসার বাসন-কোসন এবং বাঁশ-বেতের তৈরী পণ্য সংগ্রহের। তিনি জানান, একাডেমীর ঘর ও বারান্দায় সংগৃহিত সামগ্রী রাখার মতো স্থান সংকুলান হচ্ছেনা। বেশ কিছু সামগ্রী রয়েছে নষ্ট হবার ঝুঁিকতে। বৃহষ্পতি ও শুক্রবার মূলত সংগ্রহশালাটি প্রদর্শনের জন্য খোলা রাখা হয়। দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসেন সংগ্রহশালার প্রাচীন লোকজ সামগ্রী দেখতে। ভূপতি ভূষণ বর্মা জানান, মাঝে মাঝে তার আফসোস হয়, আরো আগে এই উদ্যোগটি নিলে অনেক বিলুপ্ত সামগ্রী সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। তিনি জানান, সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে সংগ্রহশালাটির বহুতল ভবন করা সম্ভব হবে। আর তাতে পৃথক গ্যালারি করে উপস্থাপন করা যাবে সংগ্রহিত সামগ্রী। তখন দেশ-বিদেশের গবেষক ও শিক্ষার্থী ও পর্যটকদের জন্য এই সংগ্রহশালাটি হতে পারে আকষর্ণের কেন্দ্রবিন্দু।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!