১২৭ বছরের ভান্ডারি প্রেস

বিভাস প্রতিবেদক
এখন ডিজিটাল যুগ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। মূদ্রণ মাধ্যমে যোগ হয়েছে কম্পিউটারসহ নানা অনুসঙ্গ। ডিজিটাল ছাপাখানাও হাতের নাগালে। এমন প্রেক্ষাপটে ১২৭ বছরের পুরাতন মুদ্রণযন্ত্র দিয়ে ছাপার কাজ করছেন গোলাম মোস্তফা ভান্ডারি নামে একজন। দু’পায়ে সচল রেখেছেন সেটি। আর পরিবারের আয়ের উৎসও সেই প্রাচীন ছাপাখানাটি। এই ছাপাখানায় এক সময় পত্রিকা ও সাময়িকী ছাপা হয়েছিল। টানা এক যুগ সেই সাময়িকী প্রকাশের পর আর্থিক কারণে বন্ধ হয়ে যায় প্রকাশনা। তাই স্থানীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে মুদ্রণযন্ত্রটি। আধুনিক প্রযুক্তির সাথে লড়াই করে মোস্তফা ধরে রেখেছেন পিতার হাতের ছোঁয়া মেশানো ঐতিহ্য।
ভুরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের সড়কের পাশেই ভান্ডারি প্রেস। জীর্ণ একটি কক্ষে বাবার রেখে যাওয়া মুদ্রণযন্ত্র দিয়ে ছাপার কাজ করছেন ছাপাখানার মালিক জয়নাল আবেদীন ভান্ডারির ছেলে গোলাম মোস্তফা ভান্ডারি ও তার সহধর্মিনী হেলেনা। এই যন্ত্রের আয়ে চলছে পরিবার।
মোস্তফা জানান, ইচ্ছে থাকা সত্বেও মুদ্রণযন্ত্রটি পরিবর্তনের সাধ্য নেই তার । তাছাড়া এর সাথে জড়িয়ে আছে বাবার স্মৃতি। প্রতিদিন কেউ না কেউ দেখতে আসে ছাপাখানাটি। আশেপাশেই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু স্কিন প্রিন্টের দোকান। বসেছে কম্পিউটার ও রঙিন প্রিন্টার। এসবের সাথে প্রতিযোগিতা করে আজো টিকে আছে এই ছাপাখানাটি।
মোস্তফা জানান, তার বাবা প্রয়াত জয়নাল আবেদীন ভান্ডারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের বাসিন্দা। জন্ম ১৮৯৮ সালে। জন্মের পর কোন এক সময়ে ভুরুঙ্গামারীতে স্বপরিবারের আসেন তিনি। স্থাপন করেন বসতি। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির ইচ্ছে ছিল তার। প্রখাশের মাধ্যম ছিলনা। তাই নিজের লেখা প্রকাশের ইচ্ছে থেকে মুদ্রনযন্ত্রটি গাইবান্ধা থেকে ক্রয় করে আনেন তিনি। স্থাপন করেন ১৯৫৮ সালে। ‘হপকিনসন এন্ড কোপ’ নামে ব্রিটিশ কোম্পানীর এই মূদ্রণ যন্ত্রটির দাম সে সময় ছিল ১০ হাজার টাকা। ছাপাখানার গায়ে লেখা একটি তৈরীর সময় ১৮৯০ সাল। এই ছাপাখানায় জয়নাল আবেদীন ‘মাসিক বার্তাবহ’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করতেন। সম্পাদক তিনি নিজেই। এতে বিভিন্ন সময় লিখেছেন সৈয়দ উদ্দিন মন্ডল, প্রভাষক খবিরুল হক, ছলিমুদ্দিন মাষ্টার, শাহাদাৎ হোসেন মাষ্টার, জালাল উদ্দিন, জেলেখা বেগম, নুর মোহাম্মদ মাষ্টার, মাওলানা আলমগীর হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও লেখক আখতারুজ্জামান মন্ডল, কবি আব্দুল হাই শিকদার, নুরজাহান শিকদার, আব্দুল হাকিম শিকদার, অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক, ডা. এম আর খান প্রমুখ।
১৯৫৮ থেকে ৬৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হয় মাসিক বার্তাবহ। পরে কিছুদিন অনিয়মিতভাবে প্রকাশ করেন জয়নাল আবেদীন ভান্ডারি। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে স্ত্রীর গয়না পর্যন্ত বিক্রি করেন। এই টাকায় কেনা হতো কাগজ। মোস্তফা জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা ভারতের কোচবিহারে চলে যান। ফিরে এসে দেখেন ছাপাখানাটি লন্ডভন্ড। তার বাবাকে মুক্তিযুদ্ধের লোক জেনে পাকবাহিনী ছাপাখানাটির ব্যাপক ক্ষতি সাধরন করে। এরপর আর সাময়িকীটি বের হয়নি।
১৯৮৭ সালে সেটেলমেন্ট অফিসের চেইনম্যান পদে চাকুরি হয় মোস্তফার। কিন্তু বাবা যেতে দেননি চাকুরিতে। চেয়েছেন তার ছেলে মোস্তফা ধরে রাখুক ছাপাখানার ঐতিহ্য। সেই থেকে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে ছাপাখানার কাজ করে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করছেন মোস্তফা। হরফের পর হরফ সাজিয়ে মূর্ত কওে তোলেন বাবার স্বপ্ন। তার ছেলে হারুন অর রশিদ রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাষ্টার্স করে বেকার। এক মাত্র মেয়ে মাহফুজা খাতুন ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন ভুরুঙ্গামারী মহিলা কলেজে।
ভিটেমাটির সামান্য জমি ছাড়া কোন সম্পদ নেই ভান্ডারি পরিবোরের। বর্তমানে সিনেমার টিকিট, হাটের রসিদ, চাঁদা আদায়ের রসিদ বই, হালখাতার চিঠি, ছোট পোষ্টার ও লিফলেট ছাপা হয়। আশেপাশের একাধিক ছাপাখানায় কম্পিউটারে-ডিজিটালযন্ত্রে পোষ্টার, ব্যানারসহ বিভিন্ন ছাপার কাজ করা হলেও কেউ কেউ এখনও আসেন এই ছাপাখানায়। পাশাপাশি বই বাঁধাইয়ের কাজও করেন তিনি। এসব কাজে তাকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন তার স্ত্রী হেলেনা। হেলেনা জানান, ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়ে। তাই তারা কাজ করার সময় পায়না। আবার কর্মচারি রাখার সামর্থ্যও নেই। তাই স্বামীকে সহায়তা করেন তিনি। তাও প্রায় ২৫ বছর ধরে এভাবে সহায়তার করছেন ।
মোস্তফা ভান্ডারি জানান, ছাপাখানাটি দিয়ে কাজ করতে প্রায়ই সমস্যা হয়। বর্তমানে পা চালিত পুরাতন মুদ্রণযন্ত্র প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই এই যন্ত্রের অক্ষর পাওয়া মুস্কিল। পুরোনো অক্ষর জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। বড় হরফের ক্ষেত্রে কাঠ দিয়ে অক্ষর তৈরী করে কাজ চালানো হয়।
ভুরুঙ্গামারীর সাংবাদিক এমদাদুল হক মন্টু বলেন, ‘জয়নাল আবেদীন একজন গুণী মানুষ ছিলেন। তার এখানে দুই বাংলার অনেক স্বনামধন্য লেখক ও কবি আসতেন। আড্ডা দিতেন। জয়নাল আবেদীনের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি মিউজিয়াম হলে তার প্রকাশিত সাময়িকী ও মুদ্রনযন্ত্র সংরক্ষণ করা যেত’।
ভুরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো: নুরুন্নবী চৌধুরী খোকন বলেন, ‘যে ছাপাখানাটি মিউজিয়ামে থাকার কথা। তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা হচ্ছে। এটি এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত। তাই প্রকাশিত সাময়িকীগুলো সংগ্রহ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখার জন্য উপজেলা পরিষদ চত্বরে একটি ছোট আকারের মিউজিয়াম করার চিন্তা আছে’।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!