নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সাহিত্য চর্চার মাতৃভূমি উলিপুর

মারুফ আহমেদ
বাংলা নাটকের একজন প্রবাদপুরুষ হিসেবেই সবাই তকে চেনেন। সেলিম আল দীনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮আগষ্ট ফেনী জেলার অন্তর্গত সোনাগাজী গ্রামে।
পিতা মরহুম মফিজ উদ্দিন ছিলেন পেশায় ডেপুটি সুপারিনটেনডপন্ট। ড. দীনের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন মৌলভীবাজার বড়লেখার সিংহগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হলেও বাবার বদলির চাকরীর সুবাদে দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুলে।
সেলিম আল দীনের বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে বাল্যকালের প্রায় অনেকটা সময়ই কাটে উলিপুরে। ১৯৫৮ সালে বাবা মফিজ উদ্দিন আহমেদ উলিপুরে ডেপুটি কাস্টমস অফিসার ছিলেন । তৎকালীন সময়ে উলিপুর জোতদার পাড়ায় অর্থ্যাৎ বর্তমান সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের পশ্চিমের দোতলা বাড়িটাই ছিল ড. দীনদের কোয়ার্টার।
উলিপুরে এসে ড. দীনকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয় এমএস স্কুলের পাঠশালা নামক অংশে যা বর্তমান মহারাণী স্বর্নময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এমএস স্কুলের প্রধান শিক্ষক নলিনীকান্ত বাবু তৎকালীন সময়ে ড. দীনের প্রতিবেশী ছিলেন। মুলত তারই পরামর্শে ড. দীনকে একই শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। দুরন্ত সেলিমের মাঝে হয়ত লুকায়িত ড. সেলিম আল দীনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন নলিনীকান্ত বাবু। ১৯৬১ সালের দিকে সেলিম আল দীনের বাবা মফিজ উদ্দিনের বদলি হয়।
ড. সেলিম আল দীন যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন তখনই পরিচয় হয় উলিপুরের এক শিক্ষার্থীর সাথে, তার মাধ্যমে ঠিকানা নিয়ে নিয়মিত পত্র লিখতেন শৈশব শিক্ষক ও প্রতিবেশী নলিনীকান্ত বাবুর মেয়ে নন্দিতা চক্রবর্তীর সাথে। কোন এক অদ্ভুত কারণে নন্দিতা চক্রবর্তী তার মনে স্থায়ীভাবে গেড়েছিলেন দিদির আসন। নন্দিতা চক্রবর্তী তার বড়বোন বুলবুলের বান্ধবী ছিলেন, তাই হয়ত সদ্য প্রয়াত বোনকে খুঁজে পেতেন নন্দিতা চক্রবর্তীর মধ্যে। শত ব্যস্ততার পরেও নিয়মিত লেখা প্রতিটি চিঠিতে উঠে আসত উলিপুর নিয়ে তার মধুর স্মৃতি ও বর্তমান ব্যক্তি জীবনের তথ্য। তার লেখা একটি চিঠির কিছু অংশ হুবহু তুলে ধরা হল। চিঠিটি পড়লে হয়ত পাঠক আমার লেখার শিরোনামের স্বার্থকতা পাবেন।
‘আমার লেখক জীবনের মাতৃভুমি উলিপুর’
‘….আমার লেখার যে অঙ্কুর উদগমিত হয়েছিল একদিন-বহুদিন আগে তাকে যদি শ্রমে-ঘামে কিছুটা বার্ধক্য দান করি, মুকলিত ঝরবার বাসনা জাগে তবে এই দীন শিল্প সেবকের স্বপ্ন সফল হয়। …… আমার জন্মভুমি ফেনীতে হলেও আমার লেখক জীবনের মাতৃভূমি উলিপুর। ….আমার লেখার সুত্রপাত ঘটে উলিপুরেই। তৃপ্তিদি, বিজলীদির কথা মনে পড়ে। হোম বাবুদের (হেমন দত্ত) বৈঠকখানায় নাট্যাভিনয়, দূর্গাপুজোর আমোদ – এমনকি পুরোহিত পঠিত স্তোত্র পর্যন্ত মনে আছে। মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুলের স্মৃতিও আন্দোলিত করে। …. এ কুড়িগ্রাম-উলিপুরের পথ আমার জন্য এতটা দীর্ঘ ও গহীন হবে ভাবিনি। ….আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাসাহিত্যের প্রচার বিঘিœত এই জন্য যে জাতি হিসেবে আমরা খুব একটা ভাল জায়গায় নেই। ইউরোপ ভ্রমন করে আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরও একটি জাতি সংহত হতে পারে নি, তার গন্তব্যের একটি ঝড়ো গতিও কালের বুকে কোন চিহ্ন আঁকতে পারে নি। হতাশা ক্রোধে নিজের মাথার চুল উপড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আত্মঘাতি জনপদে বসবাস করি আমরা। ….কোলকাতায় তৃপ্তিদির ঠিকানা জানা আছে কি? অঞ্জলি বাগচী দিদিরা কোথায়? রমেশ বলে এক বন্ধু ছিল, তারও খবর জানিনা। ….হেমেন বাবুদের বৈঠকখানায় ওদের নিয়েই বছরই একটা নাটক করেছিলাম। তাদের বাসায় প্রকান্ড একটা রেডিও সেট ছিল। তারা কোথায়? কানু স্যার বেঁচে আছেন কিনা জানিনা। … ফেব্রুয়ারী-মার্চে আমি ও অভিনেতা পীযুষ বন্দোপধ্যায় কুড়িগ্রাম আসতে পারি। খুব মনে আছে চিলমারী ও বজরা এলাকার কথা। আপনাদের বাসায় অগ্রহায়ণে বাগানে স্থলপদ্ম ফুটত, কি লোভ হত সে ফুল ছুঁয়ে দেখার। ঢুকতে বাম পাশের দিকে উঁচু গাছগুলি। সে ফুল আমারও বাগানে ফোটে, আর সেই সব দিনের মৃত ফুলেরা জীবন্ত হয়। ’
শুধু তাই নয় তার প্রতিটা নাট্যকর্ম খুব ভালভাবে লক্ষ করলে সেখানে উলিপুরের ছোঁয়া মিলে। গোবিন্দজিউ মন্দিরের মন্ত্র শোনার শৈশব স্মৃতি স্থান পেয়েছিল তার প্রতিটি সৃষ্টিতে।
বাংলা সাহিত্য-ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ও মৌলিক ধারা পুনরুদ্ধারে সেলিম আল দীন যে অবদান রেখেছেন, তা বাঙালী স্বরণ করবে চিরদীন। অনতিদীর্ঘ জীবনবৃত্ত পরিক্রম শেষে নাটকের এই দেবদূত ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যু বরণ করেন।
স্মৃতি বিজরিত ও লেখক জীবনের মাতৃভুমি উলিপুরে আর আসা হল না। হায় আফসোস!!
(তথ্যসুত্রঃ ডঃ সেলিম আল দীনের জীবনী, নন্দিতা চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিপত্র ও লেখককে দেয়া নন্দিতা চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার)

  • মারুফ আহমেদ,
    সমাজকর্মী ও ইতিহাস গবেষক, উলিপুর।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!