‘হালাবটে ৭ রাজাকারকে খতম করি’

বিভাস প্রতিবেদক
‘মহান মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রামের হালাবটে একটি ট্রেনে মাইন বিস্ফোরণ করার সময় সন্মুখ যুদ্ধে ৭ রাজাকার ও বেশ কয়েকজন খানসেনাকে খতম করি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার অপরাধে পাকসেনারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং বড় ভাই আবুল কাশেমকে গুলি করে হত্যা করে।’ যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ কথাগুলো বলেন দুধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। তিনি ৬ নং সেক্টরের অধিনে একজন প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন এবং ব্রিজ ও স্থাপনা ধবংসের জন্য ডেমুলেশন ইউনিটের প্রধান হিসেবে অনেক সাহসিকতার পরিচয় দেন মুক্তিযুদ্ধের সময়।
রফিকুল ইসলামের বাড়ি রাজারহাট উপজেলার বালাকান্দি গ্রামে। তিনি জানান, কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের সাহেবগঞ্জ চলে যান। দার্জিলিংয়ে ২৮ দিন সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর দিনাজপুরের চাউলহাটি ক্যাম্পে তাকে পাঠানো হয়। ডেমুলেশন পার্টির লিডার ছিলেন তিনি। আমার সাথে মালেক ও খলিল ছিলো।
তিনি জানান, পাঁচপীর আক্রমণের পরিকল্পনা করার জন্য আমরা জলিল চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাই। এ খবর পেয়ে কুখ্যাত দালাল দা¹িল মাওলানার নেতৃত্বে রাজাকার ও পাকসেনারা ওই চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাঁর ভাই মজিদকে গুলি করে হত্যা করে মজিদের আপন ভগ্নিপতি এছাহাক রাজাকার।
কোম্পানী কমান্ডার আব্দুল হাই বীরপ্রতীকের অধীনে আসার পর প্রথম অপারেশনের দায়িত্ব পরে কুড়িগ্রাম সদরের কাছে হালাবটের রেললাইনে মাইন পুঁতে রাখার। তিনি বলেন, ‘বীরপ্রতীক আব্দুল হাইয়ের সাথে আমি, সোনাহাটের আকবর, আইনুলসহ কয়েকজন রাতে লাইনের মাঝে গর্ত করে মাইন পুঁতিয়ে রাখি। প্রথমবার ট্রেন গেল বাষ্ট হলোনা। ১১ নং সেক্টর থেকে কোম্পানি কমান্ডার আলমের কাছে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা আনা হলো। আগে থেকে আমাদের ২০-২৫ জনের একটি দল ছিল। ২৭ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ট্রেন চলে আসার সাথে সাথে প্রচন্ড শব্দে ব্লাষ্ট হয় মাইন। পরে ট্রেনে থাকা পাকসেনারা গুলি করতে থাকে। দু’পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। পরিকল্পনামতো কাজ না হওয়ায় অনেকটা সমস্যায় পড়ে যাই। তা সত্বেও দিনভর যুদ্ধ চলার পর আমরা নিরাপদে চলে যেতে পারি। যুদ্ধে ৭ জন রাজাকার নিহত এবং আহত হন সহকর্মী মনদ্দিসহ আরো ২ জন। খান সেনারা চলে যাবার পর আমরা রাজাকারদের পুঁতে রাখা ৭টি গর্ত দেখতে পাই। নিহত পাকসেনাদের ওরা নিয়ে যায়।’
তিনি আরো জানান, ২ ডিসেম্বর সদর উপজেলায় মোঘলবাসায় ১’শ রাজাকার শর্তসাপেক্ষ আত্মসমর্পণ করার খবর দেন। শর্ত ছিল আত্মসমর্পণের পর কোন ব্যবস্থা নেয়া হবেনা। এ ঘটনার পর পাকবাহিনীর কাছে খবরটি চলে গেছে। তারা কৌশলে আরো ২শত রাজাকার আত্মসমর্পণের খবর পাঠায়। ৩ নভেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল। সে অনুযায়ী ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তুতি নেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজাকার ও পাকবাহিনী ভোরবেলা হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ করেন। গ্রামবাসীরা সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করেন। ৫ তারিখ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এতে ১৭ জন গ্রামবাসী, মুক্তিযোদ্ধা নুরু ও কয়েকজন পাকসেনা নিহত হন।
এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে ঘাটপার, পুরাতন ষ্টেশন ও রিভারভিউ স্কুলসহ কুড়িগ্রাম শহরে অবস্থানরত পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে। একে একে খবর আসতে থাকে অবস্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছে পাকবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের ৪টি কোম্পানী চারদিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে ফেললে এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে বিকালে পাকবাহিনী ৬ ডিসেম্বর ট্রেনযোগ কুড়িগ্রাম ছেড়ে চলে যায়। বীরপ্রতীক আব্দুল হাইয়ের সাথে তিনিও ওই দিন কুড়িগ্রাম নতুন শহরস্থ পানির ট্যাংকির উপর স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করার মাধ্যমে কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত করা হয়।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!