কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের অনন্য উদ্যোগ ঐতিহ্য

আব্দুল খালেক ফারুক:
ছোট-খাট একটি অপরিসর কক্ষ। রঙিন দেয়াল আর বাহারি পর্দার সৌন্দর্য ছাপিয়ে কক্ষটি অন্য কারণে রঙিন হয়ে উঠেছে। হয়েছে ইতিহাসের এক অনন্য ধারক। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের দোতলার একটি কক্ষে বিলুপ্ত প্রায় অফিস সরঞ্জামাদীর সংরক্ষণাগার ‘ঐতিহ্য’ আগ্রহীদের নজর কাড়ে। এখানে সংরক্ষিত বৃটিশ আমলের লোহার সিন্দুক, এসডিও আমলের বাহারী গেটের বাতি, মোবাইলের যুগে বাতিল টেলিফোন সেট, ই-গর্ভনেন্স এর যুগে বাতিল হওয়া টাইপ রাইডারসহ স্থান পেয়েছে ৩২ ধরণের অর্ধশত স্মারক।
সময় বদলে গেছে, বদলে গেছে জ্ঞান আর কৌশল। তবে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত কর্মকৌশল আর অফিস সরঞ্জামের সব কিছুই অপ্রয়োজনীয় ও বাতিলযোগ্য, এমনটা নিশ্চয়ই নয়। আজকের বসার আসবাব, লেখার কাগজ, লেখার পদ্ধতি, যোগাযোগের পদ্ধতি, মুদ্রণের পদ্ধতি আগে একরকম ছিলনা। এখন সব কিছুরই আধুনিকায়ন হয়েছে। আজকের সময়ে অনেকেই বুঝতে পারেন না, অফিসের সরঞ্জাম আর দারুণ কাজের সব যন্ত্র কেমন ছিল। তাই এসব ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রয়াস হিসেবে চালু করা হয়েছে ‘ঐতিহ্য’ নামের সংরক্ষণাগারটি। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ উদ্বোধন করেন এই সংরক্ষণাগারটির। এরপর থেকে সহকারী নাজির আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস দায়িত্বে রয়েছেন। এখানে রয়েছে একটি সংগ্রহিত সরঞ্জামের তালিকা সম্বলিত একটি খাতা ও একটি মন্তব্য খাতা। দর্শণার্থী ও গবেষকরা এখানে পরিদর্শন করে মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহায়তায় আলমারীর উপর, র‌্যাকের ফাঁকে, পড়ে থাকা অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হবার উপক্রম কিছু সরঞ্জাম সংগ্রহ করে সাজানো হয়েছে এই সংরক্ষণাগারটি। এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগটি নেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান। তিনি বলেন, ‘অতীতের জ্ঞান ও আর কৌশল সম্পর্কে জেনে বর্তমানে তা কাজে লাগানোর একটা প্রয়াস থেকে এই সংরক্ষণাগারটি গড়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে শুধু প্রশাসন ব্যবস্থার অতীত নয়, দেশের অনন্য ঐতিহ্য সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে।’
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে তোলা সংরক্ষণাগারটিতে রয়েছে প্রায় ৫০টি স্মারক। রয়েছে ডুপ্লিকেটিং মেশিন। স্টেনসিল পেপারে মূদ্রিত চিঠির প্রয়োজনীয় সংখ্যক অবিকল নকল (কপি) করার জন্য এই যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে কম্পিউটার ও প্রিন্টারের ব্যবহার শুরু হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে এই মেশিনটি। এক সময় কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য আরাম কেদারা আর এসডিও আমলের সৃদৃশ্য বাতি স্থান পেয়েছে এখানে। ডট মেট্রিক্্র প্রিন্টার দিয়ে স্টেনসিল পেপার কাটা হতো। বর্তমানে ফটোকপিয়ার মেশিন চালু হবার পর বন্ধ হয়ে গেছে এর ব্যবহার। সেটিও স্থান পেয়েছে এখানে। নানা মডেলের বেশ কিছু পুরাতন টাইপ রাইটার মেশিন রয়েছে এই সংরক্ষণাগারে। আছে ইলেকট্রিক টাইপ রাইটার ২০০২ সালের পর যা বন্ধ হয়ে যায়। রয়েছে থিন পেপার, আলপিন ও পিন কুশন, কারেক্টিং ফ্লুইড, কার্বন পেপার, মাইক্রো ফ্লপি ডিস্ক। আরো রয়েছে পিতলের টোকেন, যা বিল দাখিলকারীদের দেয়া হতো। মোবাইল ফোনের যুগে টেলিফোনের ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। বর্তমানে সকল টেলিফোন পুশ বাটনে চলে। পূর্বে এনালগ পদ্ধতিতে আঙ্গুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডায়াল করতে হতো। ১৯৯৮ সালে এই অফিসে ব্যবহৃত এ ধরণের একটি টেলিফোন ও ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক প্রিন্টিং ক্যালকুলেটর সংগৃহীত রয়েছে এখানে। ১৯৮৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তারিখে কুড়িগ্রাম মহকুমা জেলায় উন্নতি হয়। থানা ছিল ১৩টি। বর্তমানে লালমনিরহাট জেলাটিও কুড়িগ্রাম মহকুমার অন্তর্ভূক্ত ছিল। দীর্ঘ সময়ে মহকুমা থাকার পরেও বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের প্রশাসন পরিচালনায় ব্যবহৃত অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তবে এই সংরক্ষণাগারটিতে বৃটিশ জমানার একটি লোহার সিন্দুক রয়েছে। এই সিন্দুকটিতে গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেত, সরকারি আদায়কৃত অর্থ, দাখিলা ও ডিসিআর বই সংরক্ষণ করা হতো। এখন এ ধরণের সিন্দুকের ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে বিরাটাকারের সিন্দুকটি দেখে অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় । এক সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে লাল রঙের ফিতা দ্বারা বাঁধা হতো অফিশিয়াল নথি। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা বোঝাতে ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম’ শব্দটি ব্যাপক প্রচলিত। তবে বর্তমানে জনবান্ধব প্রশাসনের ধারণা স্বীকৃত হবার পর ফাইলে লাল ফিতার ব্যবহার নেই। সব ফিতাই সাদা। পাশাপাশি গণবান্ধব প্রশাসনের অংশ হিসেবে প্রতিসপ্তাহে একদিন জেলা প্রশাসক ‘গণশুনানি’তে জনগণের সমস্যা শুনে তাৎক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করেন। ই-ফাইলিং পদ্ধতিতে দ্রুত ফাইল নিষ্পত্তি করেন। সে কারণে ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম’ এখন অনেকটাই পুরোনো স্মৃতি বলে মনে করেন প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা।
‘ঐতিহ্য’ নামের সংরক্ষণাগারটির ব্যাপ্তি এখনও ছোট থাকলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে এর সংগ্রহের তালিকা। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা: সুলতানা পারভীন জানান, উপজেলা পর্যায়ের অফিসগুলো থেকে পুরাতন সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ সফল হলে আগামীতে স্মারকের সংখ্যা বাড়বে। তখন একটি বড় কক্ষে সংরক্ষণাগারটি স্থানান্তরিত করা হবে। তিনি আরো জানান, গবেষক ছাড়াও সাধারণ মানুষের দেখার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে সংরক্ষণাগারটি। সীমান্তবর্তী অনগ্রসর জেলা কুড়িগ্রামে এই উদ্যোগটি শুরু হলেও এটি একদিন সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে বলে তাঁর বিশ্বাস।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!