পর্ব-এক: সেচের জল নিয়ে মমতার রাজনীতি

হিলি স্থল বন্দরে ৬ ধরণের চেকিং ও আনুষ্ঠানিকতা শেষে যখন ভারতভূমিতে প্রথম পা রাখলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্রথম গন্তব্য দক্ষিণ দিনাজপুর। হিলি থেকে দুরত্ব ৬৩ কিলোমিটার। তবে ফাঁকা ও প্রশস্ত পথে যেভাবে আমাদের বহনকারি ট্যাক্সি এগিয়ে চলছে, তাতে গন্তব্যে পৌঁছতে খুব বেশী সময় লাগবেনা। আমার সাথে রয়েছেন আমেরিকা প্রবাসী চৌধুরী সফিউদ্দিন। দৈনিক কালেরকণ্ঠে প্রকাশিত দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীর বিষয়ে আমার রিপোর্টের সুত্র ধরে যার সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্টতা। সাথে রয়েছেন তার শ্যালক ঢাকার ব্যবসায়ী হীরা ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বাসিন্দা তার ভাতিজা সোহেল। বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেই প্রথমেই যা মুগ্ধ করলো, তা হচ্ছে প্রশস্ত ও মসৃন সড়ক। কোথাও ভাঙাচুরা নেই। কিছুদুর পর পর বিলবোর্ডে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ছবি। বিলবোর্ডে লেখা সেইভ ট্রাইভ, সেইভ লাইফ। স্থানে স্থানে চেক পোষ্ট। সেখানে পুলিশ ছাড়াও ভলান্টিয়াররা দায়িত্ব পালন করছেন। সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি মমতার অগ্রাধিকার কর্মসূচি। এসে ব্যাপক সাফল্য পুরো পশ্চিমবঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। রাস্তায় রাস্তায় বসানো হয়েছে সিসি টিভি। ট্রাফিক আইন লংঘন করলেই সাথে সাথে পুলিশ ধরে ফেলে তা নয়, বরং বাড়িতে কেস স্লিপ চলে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এই ভীতির কারণে সড়কে শৃংখলা এসেছে পুরো রাজ্যে।
হিলি থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরের দৌলতপুর পৌঁছতে ৩টি নদীর দেখা মিলল। পুণর্ভবা, টাঙ্গণ ও আত্রাই নদী। সব কটি নদীর শীর্ণ দশা। জল নেই। ক’দিন আগে ছিল একেবারে শুকনো। এখন বৃষ্টিতে সামান্য ছিপছিপে জল। তিস্তার জল নিয়ে যেহেতু মমতার সাথে বাংলাদেশের মানুষের দুরত্ব তৈরী হচ্ছে, তাই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ রয়েছে আমার। আগের দিন মমতা দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুরে এক জনসভায় এ ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন মমতা। আমরা বুনিয়াদপুর পার হবার সময় সোহেল আমাদেরকে জনসভাস্থল দেখিয়ে দিল। এছাড়া পরদিন আমাদের গন্তব্যস্থলের ৩৫ কিলোমিটার দুরে মালদায় অপর এক জনসভায় ভাষণ দেন মমতা।
জনসভায় মমতা বলেছেন, রুগ্ন তিস্তার জল বাংলাদেশকে দিলে কোচবিহার ও জলপাইগুঁড়িতে চাষের জল থাকবেনা। এ দ’ুটি জনসভায় মমতা বলেছেন, তিস্তার জলতো দেয়া সম্ভব নয় বরং আত্রাই নদীর জল বাংলাদেশ আটকানোর কারণে পশ্চিমবঙ্গে যে সেচের জলের সংকট তৈরী হয়েছে, এ বিষয়ে দিল্লীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পত্র লিখবেন তিনি। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ‘দক্ষিণ দিনাজপুরের দীর্ঘতম নদী আয়েত্রী (আত্রাই)। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৮ কিলোমিটার। এপারে সমজিয়া সীমান্তে ১৪০০ মিটার দূরে বাংলাদেশের মোহনপুরে আয়েত্রীর উপর আড়াআড়ি বাঁধ ও লকগেট তৈরীর ফলে দু’বছর ধরে জলসংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ভারতের তৈরী ৫৫টি রিভারলিষ্ট ইরিগেশন (আরএলআই) অকার্যকর হয়ে গেছে।’ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান হচ্ছে। আর মমতাকে পা ফেরতে হচ্ছে হিসেব করে। তাই দেখে শুনে মনে হলো রাজনীতির স্বার্থেই মমতা তিস্তার জলের ব্যাপারে কোন ছাড় দিবেননা।
হিলি থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর যাবার পথে অল্প কিছু এলাকায় পাট ও ধানের আবাদ দেখা গেলেও বিস্তৃর্ণ আবাদী জমি ফাঁকা দেখে বিস্মৃত হলাম। দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে মালদা এবং সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা যাবার পথে একই দৃশ্য চোখে পড়লো। কত হাজার হেক্টর জমি যে পড়ে আছে বোঝা মুশকিল। গম কেটে নেয়ার পর ফাঁকা পড়ে রয়েছে জমি। বহরমপুরে কিছু ধান ও মুর্শিদাবাদে পাটের আবাদ চোখে পড়লেও অন্য এলাকাতে একই অবস্থা। বিহারে পশুপালন করা হয়। স্থানীয় কৃষকরা জানালেন, তারা মুলত সেচের জলের অভাবে বছরে ৩টি ফসলের চাষ করার চিস্তা মাথায় আনতে পারেন না। তাই আমন ও গম চাষ করে অপেক্ষা করেন বৃষ্টির জলের। গম ক্ষেতেও জল দেয়া হয় এক সাথে শত শত একর জমিতে। তার উপর রয়েছে মজুর সংকট। তারা আরো জানান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সন্তানরা গম কাটার পর চলে গেছেন দিল্লী ও কেরালাসহ বিভিন্ন এলাকায়। কয়েকমাস কাজ করে আনছেন মোটা অংকের টাকা। সেই টাকায় স্বচ্ছলতাও এসেছে সবার সংসারে। মজুর সংকট কাটারে কৃষিপ্রধান এলাকাগুলোতে কম্বাইন হার্ভেষ্টারের ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। গমে প্রতি কুইন্টালে ১ কিলো বা কেজি আর ধানে ১৪-১৫ কেজি করে কাটাই ও মাড়াইয়ের চার্জ আদায় করেন হার্ভেষ্টারের মালিকরা। তাতে মজুর দিয়ে ফসল কর্তনের চেয়ে অনেক কম খরচ পড়ে। বাংলাদেশে যেভাবে মজুর সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ছে-তাতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কোন বিকল্প নেই-অভিজ্ঞতায় তাই মনে হয়েছে। মালদাহ থেকে ফারাক্কা পেরিয়ে ট্রেনে কলকাতা ও ট্যাক্সিতে মুর্শিদাবাদ যাবার পথে ফারাক্কা ব্যারাজটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বহু বছর ধরে এই ব্যারাজ নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। বাস্তবে তা দেখে পুলকিত হলাম। সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত ব্যরাজের ছবি তুলতে মানা। রয়েছে সেন্ট্রাল পুলিশের টহল চৌকি। পশ্চিম প্রান্তে একটি ফিডার ক্যানেল দিয়ে গঙ্গার জল সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সেখানে যে গতিতে জল ঢুকছে আর অপর প্রান্তে সাগরের মতো উত্তাল ঢেউ সৃষ্টি করছে-চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। অথচ ব্যারাজের ভাটিতে পদ্মা শুকিয়ে আছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, গঙ্গার পানি সরিয়ে যে ফিডার ক্যানেলটি তৈরী করা হয়েছে তা নদীয়া, মুর্শিদাবাদের ভাগিরতি ও পরে হুগলি নদীর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। স্বচ্ছ এই জল কলকাতার হলদিয়া বন্দরকে সচল রাখছে। আর পবিত্র গঙ্গা জলে স্নান করে তৃপ্ত হচ্ছেন হিন্দু ধর্মালম্বিরা। ফারাক্কা ব্যারাজের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ২৪০ কিলোমিটার। ৪০ হাজার কিউসেক জল সরিয়ে নেয়ার নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৯৮ সালে ফারাক্কা চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ ৩৭ হাজার কিউসেক জল পাবার কথা থাকলেও বাস্তবে তা পায়না।
কৃষি ও পশুপালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করলাম। বাংলাদেশে কৃষকদের চিরায়ত অভিযোগ ফসলে পোকার আক্রমণ হলে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ পাওয়া যায়না। অথচ শুধু কৃষি বিভাগ নয়, পঞ্চায়েতের মাধ্যমেও কৃষকদের নানা সেবা দেয়া হয়। ফসলের বিষয়ে কোন পরামর্শ নিতে হলে কৃষি ট্রেনিং সেন্টারে জানাতে হয়। তারা পরিদর্শনপূর্বক পরামর্শ দেন। কৃষাণ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ৫ ভাগ সুদে কৃষি ঋণ দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে ২-৩ ভাগ ভুর্তুকি দেয়া হয়। দৌলতপুর বাজারে দেখা গেল একটি গাড়ির সামনে লেখা ‘ভ্রাম্যমান প্রাণি চিকিৎসা কেন্দ্র’। গাড়ির মালিক দিলীপ ভট্রাচার্য জানালেন, দৈনিক ৭০০ ভাড়ায় তার গাড়িটি প্রাণি সম্পদ বিভাগ ব্যবহার করছেন। মাসে ২০ দিন বিভিন্ন গ্রামে ক্যাম্প করে বিনামুল্যে পশুচিকিৎসা ও ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে বন্যার সময়ই অনেক এলাকায় ভ্যাকসিনের অভাবে অসুস্থ হয়ে অনেক পশু মারা যায়।
অন্তদয়, বিপিএল ও এপিএল নামে ৩ ধরণের রেশন কার্ড দরিদ্রতার রাশ টানার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্তদয় কার্ডে ভিক্ষুক ও ভূমিহীনদের বিনামুল্যে ২০ কেজি চাল ও ২০ কেজি গম দেয়া হয়। বিপিএল কার্ডে ২ টাকা কেজিতে চাল ও গম দেয়া হয়। আর এপিএল কার্ডে ১৪-১৫ টাকায় চাল এবং ন্যায্যমুল্যে তেল, চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য দেয়া হয়। আগেও এসব কার্ড চালু ছিল। তবে সিপিএম যুগে এসব কার্ড নিয়ে নাকি দুর্নীতি হতো। এখন সে রকম অভিযোগ কমই শোনা যায়।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!