মফিজ লজ্জা পায়

১.
বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম জেলা কুড়িগ্রাম-লজ্জা পাবার জন্য এটাই ছিল যথেষ্ট। কিন্তু এতেও ল্যাঠা চুকে যায়নি। গরীবের শীর্ষস্থানটি অক্ষুন্ন থাকার পাশাপাশি এবার প্রায় ৭ ভাগ দারিদ্র্য বেড়েছে কুড়িগ্রামে। তাই নিয়ে এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে কান্না-হাহাকারের ¯্রােত বইছে। অনেকেই বিদ্রুপ-তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমায় বাকবাকুম করতে কসুর করছেননা। জিঙ্গাসা সবার-কেন এই অধোগতি। আমরা কুড়িগ্রামের প্রায় ২০ লাখ মানুষ কোথায় যাচ্ছি। গন্তব্য কোথায়? বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দায়টা আমাদের মহান জাতীয় সংসদ সদস্যদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে। তা হবেনাই বা কেন? জগদ্দল পাথরের মতো বুকে জেঁকে বসা ওই সব ভিন গ্রহের মানুষরা আমাদেরকে ‘মফিজ’ বানানোর সব আয়োজন চূড়ান্ত করেছে। ৩৮ বছর ধরে আমাদের যাঁতাকলে পিষে মারছে তারা।
২.
সাংবাদিক ইন্টারভিউ করছেন কুড়িগ্রামের এক সংসদ সদস্যের। তিনি যথারীতি সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। প্রশ্ন-উত্তর এনজয় করার মতো।
সাংবাদিক: এবারও কী আপনি দলের মনোনয়ন পাবেন।
এমপি: আমি পাব নাতো কে পাবে. কুড়িগ্রামের যত উন্নয়ন-আমিইতো করেছি। আর কে কী করেছে?
সাংবাদিক: আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ-এলাকায় কম আসেন।
এমপি: অসুস্থ ছিলাম। তাই কম এসেছি। তবে নিয়মিত খবরাখবর নিয়েছি।
সাংবাদিক: গণসংযোগ না করতে পারার মতো অসুস্থ হলে আগামীতে নির্বাচন করবেন কীভাবে?
এমপি: অসুস্থও সবাই হতে পারে। অপারেশনও হতে পারে। শেখ হাসিনার অপারেশন হলোনা? তাই বলে কী তিনি আনফিট?
সাংবাদিক: দলের নমিনেশন পাবার ব্যাপারে কোন শঙ্কা আছে?
এমপি: কে আমাকে নমিনেশন দিবে। আমি নিজেই নমিনেশন দেই। (শান্ত হয়ে) আমাকে ছাড়া আর কাকে নমিনেশন দিবে?
সাংবাদিক: উত্তর দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এই সংসদ সদস্য ৭৯ সাল থেকে বেশীরভাগ সময়ে মন্ত্রী- এমপি থেকেছেন। সরকার বদল হয়েছে। উনি বহাল থেকেছেন। মাঝে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ছিটকে পড়েছেন রেস থেকে। বিএনপি, আওয়ামীলীগ, জাপা, স্বতন্ত্র-নানাভাবে এমপি পদটি পাকাপোক্ত করার কোশেশ করেছেন। ইনি জাতীয় সংসদে মাঝে মধ্যে প্রশ্ন-উত্তরে অংশ নেন। আবার সেগুলো ছাপিয়ে জনগণের মধ্যে বিতরণ করেন। জিয়ার আমলে কী করতে চেয়েছেন-এখনও বগলে তার স্মারক ইট আর ফাইল নিয়ে ঘোরেন। এলাকার খবর রাখেন না। চীন থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ফর্মূলা বাতলান। নিজে এলাকায় আসেন না। ভাই বেরাদারদের দেদার দুর্নীতির সুযোগ করে দেন। বাবা ছিলেন প্রখ্যাত রাজাকার। আর ছেলে দেশপ্রেমিক! হরিপুরে নির্মীয়মান তিস্তা ব্রিজে রেল সংযোগ দেয়ার কথা বলতেই তিনি গাঁজা খাবার পরামর্শ দিয়েছেন এক উন্নয়ন আন্দোলনের নেতাকে। বন্দর, রেল, সড়ক আর শিল্প কারখানা ছাড়া কী করে জেলার উন্নয়ন হবে-জনাবের জবানে শুনতে পেলে ভালো হতো।
৩.
আর একজন এমপি আছেন-তার নজর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর টিআর জিআর কাবিখার চাল গমের উপর। এলাকার প্রধান সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয় নিজে সভাপতি অথবা অনুগতদের সভাপতি করে গণহারে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। কোটি টাকার বাণিজ্য করে চলছেন। চোখের সামনে। দুর্নীতি দমন বুরে‌্যা নিরব। গরীবের হক খয়রাতি চালের বরাদ্দ এনে লুটেপুটে খান তার সাগরেদরা। ইনি মামার কল্যাণে প্রথমবার এমপি হয়েছেন। আরেক মামা এখন তাকে বুকে আগলে রেখে ধারাবাহিক পদবী বাগাতে সাহায্য করছেন। আম পাবলিকের কোন জবাব নেই। দেয়ার সুযোগও নেই। অন্য এমপিও মন্ত্রী-এমপি-হুইপ হয়ে রাজতন্ত্র চালু করেছেন। এখন বছর-দ’ুবছরে একবার এলাকায় আসেন-সাইরেন আর বাঁশি বাজিয়ে-পথের ধূলা পরিস্কার করে। হায় পাবলিক! ১২ হাজার ভোট পেয়ে যার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তার টাইট শিডিউলে এলাকায় আগমন আর মিটিং সিটিং ইটিং দেখে তোমাদের তৃপ্ত থাকতে হয়। ব্রহ্মপুত্রের ওপারে আর একজন আছেন। মহা ধরিবাজ। চেয়ারম্যান থেকে প্রমোশন পেয়ে এমপি হয়েছেন। এখন নিজে আর ছেলেকে দিয়ে প্রজেক্ট বানিয়ে হরিলুটের নতুন কায়দা আবিস্কার করে লোবেল পাবার তালে আছেন। বিদ্যুৎ সংযোগ দিতেও নাকি নজরানা দিতে হয় তাকে। দয়াল বাবা বটে!
কী উন্নয়ন করবেন ওনারা। এলাকার কোন সমস্যা কী তাদের পোড়ায়? লাখো যুবকের কর্মসংস্থান আর দারিদ্র্য দূরিকরণে আছে কী তাদের কোন কর্ম পরিকল্পনা? না-নেই। তাই দিনে দিনে কুড়িগ্রামবাসীর এই অধোগতি। প্রতিনিধি পরিবর্তনের সুযোগও ভোটারদের নেই। গায়েবী নমিনেশন আসে। আর ধর্মগ্রন্থের মতো তা মানতে হয় আমাদের। এমনই অভাগা আমরা। ফেসবুকে বুক চাপরানো আত্মনাদ প্রকাশ করা ছাড়া কে কী করতে পারেন?

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!