ভাওয়াইয়ার শিল্পী অনন্ত দেব

শফিকুল ইসলাম শাওন: ভাওয়াইয়া ও লোকসঙ্গীতশিল্পী অনন্ত কুমার দেব। অনন্ত নামেই তিনি সবার কাছে বেশি পরিচিত। প্রায় চার দশকের বেশি সম ধরে মাটির ও মানুষের টানে গান গেয়ে যাচ্ছেন। মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসায় জাগ্রত মানুষটি জীবনে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন সঙ্গীত চর্চায়। লোকসঙ্গীত ও ভাওয়াইয়া সঙ্গীতকে বর্তমান প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই চালিয়ে যাচ্ছেন একনিষ্ঠ সাধনা। আধুনিকতার নামে বর্তমান প্রজন্ম পাশ্চাত্য, হিন্দি ও কলকাতার কিছু কমার্শিয়ান বাংলা গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, যেখানে বাংলার মাটি ও মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই। পরের জিনিসের মোহে নিজেদের স্বকীয়তাকে ভুলে যাওয়ার উপক্রম। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যখন জোয়ার, ঠিক তখনও মাটি ও মানুষের গানকে লালন করে নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন গুণী শিল্পী অনন্ত কুমার দেব।

গুণী এই শিল্পী ১৯৫৩ সালের ১৬ই মার্চ কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের দেবালয় গ্রামের দেব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত যতীন্দ্রনাথ দেব এবং মাতা মৃত প্রফুল্লবালা দেব। বাবা ছিলেন শিক্ষিত, জ্ঞানপিপাসু ও সঙ্গীতজ্ঞ। মা গৃহিনী ছিলেন, কিন্তু তিনিও সঙ্গীতচর্চা করতেন। সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম গ্রহণের সূত্র ধরেই মুখে যখন আধো আধো বোল ফুটেছে, তখন থেকেই মা-বাবাকে গাইতে দেখেছেন। সকালে ঘুম ভাঙত হারমোনিয়াম, তবলা, মন্দিরা ও বেহালার সুর শুনে। সন্ধ্যা হলেই বাড়িতে বসত গানের আসর। কখনো বাবা হারমোনিয়াম বাজাতেন, ভাই তবলা, কখনো মায়ের হাতে থাকত মন্দিরা। একে একে পরিবারের সবাই গান পরিবেশন করতেন। আর শিশু অনন্ত কুমার দেব শুনতেন মন দিয়ে। সঙীতচর্চা ছিল পরিবারের আবশ্যিক বিষয়। সঙ্গীতের জন্য মায়ের হাতের মার পর্যন্ত খেয়েছেন! পারিবারিক সঙ্গীতচর্চা তাঁকে সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী করে তোলে। মা-বাবার অনুপ্রেরণায় ধীরে ধীরে হারমোনিয়ামে গান তুলতেন। ২য় শ্রেণিতে পড়ার সময় মা তাঁকে শিল্পী অতুলপ্রসাদ সেনের ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’ গানটি হারমোনিয়ামে তুলে দেন। এটিই ছিল জীবনের প্রথম গান। সিংহীমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে এই গানটি গাওয়ার মাধ্যমেই সঙ্গীতাঙ্গণে শুরু হয় তাঁর বিচরণ । কৈশোরে এক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে তিনি প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী কছিম উদ্দীনের দৃষ্টি কাড়েন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের যোগ্যতা লাভ করেন। পাশাপাশি তিনি কুশান গানের (পালাগান) দলে যোগ দেন। দলের নাদু গিদাল ছিলেন প্রধান গায়েন, আর চিন্তা মোহন ছিলেন দোহার। কিছু দিন পর তিনি গানের দলের চতুর চরত্র দোহারের ভূমিকায় শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। কুশান গান, ভাওয়াইয়া গানের প্রাণ। আর সেখান থেকেও তিনি ভাওয়াইয়া ও লোকসঙ্গীতের গভীরতা উপলব্ধি করেন। কছিম উদ্দীনের সাথে দেশের বিভিন্ন জেলায় সঙ্গীত পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেন। কুশান গান ও দোতারা গানের আধুনিকায়ক হিসেবে কছিম উদ্দীনের সহযোগী ছিলেন। তিনি দেশের অধিকাংশ বেতার কেন্দ্রেই সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

প্রতিভাবান শিল্পী অনন্ত কুমার দেব ১৯৭৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রংপুর বেতারে ভাওয়াইয়া ও পল্লিগীতি শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং ২০১১ সালে রংপুর বেতারে বিশেষ শ্রেণির শিল্পী হিসেবে উন্নীত হন। এছাড়াও ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে লোকগীতির শিল্পী হিসেবে মনোনীত হন এবং ২০১১ সালে সেখানেও বিশেষ শ্রেণির শিল্পী হিসেবে উন্নীত হন। দীর্ঘকাল কুড়িগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে সঙ্গীত বিষয়ক শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর হাতে গড়া কুড়িগ্রামের অনেক শিল্পী এখন বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী। তাঁর শিষ্যদের অনেকেই এখন খ্যাতি লাভ করেছেন সঙ্গীতাঙ্গণে।

সারা জীবন সঙ্গীতের ক্ষেত্রে পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব তিনি করেন নি। তবুও ১৯৯৪ সালে লোকসঙ্গীতে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন, গাইবান্ধা  ও ২০০১ সালে ছিন্ন মুকুল,বাংলাদেশ  তাঁকে গুণী শিল্পী সম্মাননা প্রদান করে।

বর্তমানে লোকসঙ্গীত সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছেন। অবসরে স্থানীয় পত্রিকায় আঞ্চলিক ভাষায় কলাম লেখেন, চিত্রাঙ্কন করেন এবং ভাওয়াইয়া ও লোকসঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেড় শতাধিক ভাওয়াইয়া গান রচনা করেছেন এবং সুর দিয়েছেন। ভাওয়াইয়াকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছড়িয়ে দিতে নিজ হাতে গড়েছেন প্রিয় সংগঠন- ভাওয়াইয়ার আসর । যে দায়িত্ব তিনি বহন করছেন, মৃত্যুর পুর্বে তাঁর কোনো প্রিয় শিষ্যের হাতে তা তুলে দিতে চান।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!