করোনা মোকাবেলায় জামার্নির ৩ কৌশল

করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ ছোবলে গোটা বিশ্ব আজ উদ্বিগ্ন ও বিপর্যস্ত। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল দেখে বিশ্ববাসী এখন দিশেহারা। এই দু:সময়ে বিশ্বের প্রতিথযশা বিজ্ঞানী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও নীতি-নির্ধারকরা কেমনজানি থমকে গেছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ যেমন ইটালি, স্পেন, ফ্রান্সে এখন লকডাউন অবস্থা বিরাজ করছে। ইউরোপসহ বিশ্বের এই মহামারী অবস্থায় অন্য সব দেশকে অনুসরণ না করে জার্মানি অনুসরণ করছে তাদের নিজস্ব পন্থা। জার্মানির অভিজ্ঞতার আলোকে আমার কিছু ব্যক্তিগত শিক্ষণীয় তথ্য এখানে আলোকপাত করছি।
জার্মানির ৮৩ মিলিয়ন জনগণের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬২ হাজারের কিছু বেশি লোকের কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। দেশটিতে এই ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে প্রায় ৫৪১ জন অর্থাৎ ০.৯ শতাংশ লোক মারা গেছে যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অতিনগণ্য। যেখানে বর্তমান বিশ্বে গড় মৃত্যুর হার প্রায় ১৮% সে অবস্থাতে জার্মানিতে আক্রান্তের হারের চেয়ে মৃত্যুরহার অনেক কম এমন প্রশ্নের জবাবে জার্মানির ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিয়ান ড্রসটেন বলেন, মৃত্যু হার এত কম হওয়ার পিছনে অন্যতম কারন হচ্ছে জার্মানিতে প্রচুর পরিমাণে করোনার ল্যাবরেটরি টেস্ট করানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন, গত এক সপ্তাহে জার্মানিতে অর্ধ-মিলিয়ন অর্থাৎ ৫ লক্ষ করোনা টেস্ট করানো হয়েছে, এ জন্য এখানে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর সংখ্যাটা খুবই কম। এই প্রসঙ্গে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি জার্মানির বন শহরের যে এলাকায় বাস করি সেখানকার একটি স্কুলের একজন শিক্ষকের করানো টেস্ট পজিটিভ হয়েছিল বিধায় ওই স্কুলের সকল ১৮৫ শিক্ষার্থী ও তাদের পুরো পরিবার এবং স্কুলের সকল স্টাফদের পরিবারসহ টেস্ট করানো হয়েছিল এবং সকল পরিবারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পযর্ন্ত লকডাউন অবস্থায় রাখা হয়েছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,ব্যায়ামাগার, নাইটক্লাব ও রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এমতবস্থায় দেশটির প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাসায় বসে অফিসের কাজ করছে।
গণপরিবহনগুলো স্বাভাবিকহলেও লোকজন কমে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ড্রাইভারের নিরাপত্তার স্বার্থে বাসগুলোর সামনের দরজা লক করে দেয়া হয়েছে। সকল ধরনের সভা সমাবেশ ও সামাজিক প্রোগামগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ৫০ জনের বেশি লোক এক জায়গায় সমবেত হওয়া নিষিদ্ধ, দুজন লোকের বেশি একসাথে চলাফেরা করা যাবেনা এবং একজন মানুষ হতে আরেকজনের দুরত্ব কমপক্ষে ১.৫ মিটার এর বেশি বজায় রেখে কথোপকথন ও চলাফেরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুপারশপগুলোতে কেনাকাটার জন্য সবাইকে নির্দিষ্ট ট্রলি ব্যবহার এবং একসাথে দুজনের বেশি প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখানে বিধিনিষেধগুলো খুব কঠোরভাবে আরোপ না করলেও সবাই নিজের দায়িত্ববোধ থেকে অধিক সতর্কতার সহিত দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, এখন পযর্ন্ত আমি কোন জার্মানদের মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লোভস পড়তে দেখিনি। এদের ধারণা অনুযায়ী, ভাইরাস কখনো বাতাসে ছড়ায়না, তারপরও করোনা ভাইরাসটির একটু ভারী হওয়ায় এক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার খুব ফলপ্রসু নয়। যেহেতু ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাাশির সিক্রেশন ড্রপলেটের মাধ্যমে অন্য কাউকে সংক্রমণ করতে পারে, বিধায় এখানে সামাজিক দূরত্ব তথা একজন মানুষ থেকে আরেকজনের কমপক্ষে ১.৫ মিটার দুরত্ব বজায় রাখা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে। প্রায় সকল অফিস খোলা রাখা হয়েছে,কিন্তু কাজের ঘন্টা নমনীয়। অফিসের প্রায় সকল কাজ ই-মেইলে বা ফোনের মাধ্যমে করা যাচ্ছে কিন্তু জরুরি কোন কাজ অ্যাপয়নমেন্ট নিয়ে করতে হচ্ছে। বিভিন্ন অফিস, সুপারশপ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণাগারের প্রধান দরজাগুলোতে নোটিশে সবকিছুর নির্দেশনা দেয়া আছে, আর হাত ধোয়ার জন্য ওয়াশরুমগুলোতে রাখা হয়েছে বিশেষ স্যানিটাইজার।

করোনা প্রতিরোধে জার্মানিমূলত তিনটি পন্থা অবলম্বন করতেছে, তা হচ্ছেঃ অনুসন্ধান, আইসোলেশন এবং রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা প্রদান। কোভিড-১৯ আক্রান্তে কোনো উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক টেস্ট করানো, টেস্ট পজিটিভ হলে সেই ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সম্ভাব্য সকলের টেস্ট করানো হচ্ছে। যাদের টেস্ট পজিটিভ হচ্ছে তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাদের অবস্থা খুব ক্রিটিকাল তাদের হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মৃদু উপসর্গ এমন কি সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তিরা প্রচুর পরিমান শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার মাধ্যমে এই ভাইরাস প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যেহেতেু ভাইরাসটির বিরুদ্ধে এখন পযর্ন্ত কোন টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, তাই জার্মানরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সচেতনতাকেই এই মহামারীর হাত থেকে রক্ষার একমাত্র কৌশল হিসেবে অবলম্বন করছে।
পরিশেষে জার্মানির অভিজ্ঞতা থেকে আমি যে বার্তাটি বাংলাদেশের সবাইকে দিতে চাই, সেটি হচ্ছে- যেহেতু উন্নত দেশগুলোর মত আমাদের বেশি বেশি টেস্ট করানোর সক্ষমতা নেই, তাই পুরোপুরি লকডাউনই হতে পারে আমাদের সর্বোত্তমপন্থা। সর্দি, জ্বর আর কাশি- এই তিনটি উপসর্গ দেখা দিলে হাসপাতালে না গিয়ে সম্পর্ণরূপে আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ করা উচিত। অন্যান্য প্রয়োজনীয় সতকর্তা অবলম্বনের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের প্রত্যেকদিনের শারীরিক ব্যায়াম আর ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখবেন, করোনা মানেই মৃত্যু নয়। তাই গুজবে কান দিয়ে আতঙ্কিত হবেন না, সচেতনতাই এর একমাত্র সমাধান।

লেখক: মো: নূর-ই-আলম সিদ্দিকী, পিএইচডি ফেলো, ইউনিভিার্সিটি অব বন, জার্মানি । সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর । মোবাইল: +৪৯০১৭৪৩৭৮২১৮২ ই-মেইলঃ nuralambmb@gmail.com

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!