তপন রায়, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে:
কোরিয়াতে এখন বসন্তকাল, কিন্তু কোরিয়ার জনসমাজে নেই কোন বসন্তের আমেজ। প্রতিটি সময় অতিবাহিত হচ্ছে উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে। লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি । কার্যকর ব্যবস্থা আর কড়া নিরাপত্তায় করোনা নিয়ন্ত্রণ করেছে কোরিয়া সরকার । তবুও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে । এখনও দৈনিক ১০-২০ জন আক্রান্ত ধরা পড়ছে, আগামী এপ্রিলের ৫ তারিখ পর্যন্ত সামাজিক মেলামেশা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী, তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
কোরিয়ানরা জাতি হিসেবে সচেতন, তাদের দূরত্ব বজায় রাখাটা অন্যতম কার্যকর একটি উপায় হিসেবে কাজ দিয়েছে, কিন্তু এত কিছুর পরেও একদিনের জন্য কাজ থেমে নেই । পৃথিবীব্যাপী লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। একই সাথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। কিছু দেশ যথাযথ সময়োপযোগী কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে ভাইরাসটির বিস্তৃতি রোধে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এদের মধ্য অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া। করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সরকার উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা একযোগে কাজ করেছে। ব্যাপকভাবে পরীক্ষা চালু রেখেছে, একই সাথে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা এবং সামাজিক মেলামেশাকে নিরুৎসাহিত করেছে শান্ত ও ধীর চলার নীতিতে।
যাদের উপসর্গ রয়েছে, শুধু তাদের পরীক্ষা করাই যথেষ্ট নয়। ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে, তাদের শনাক্ত করে আলাদা করেছে। সিসিটিভি ফুটেজ, ডাটা ব্যবহার দেখে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করে ।
এখন পর্যন্ত দেশটি ৩ লাখ ৫০ হাজার এর উপর মানুষকে পরীক্ষা করেছে । প্রতিদিন বিনামূল্যে ১৫ – ২০ হাজার লোকের পরীক্ষা চালাচ্ছে। করোনা উপসর্গ রয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে কারা মেলামেশা করেছে, তা শনাক্ত করা হচ্ছে। ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড বিশ্বে নগদ ছাড়া লেনদেনের পরিমাণ দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে।। লেনদেনগুলি ট্র্যাক করে, মানচিত্রে কোনও কার্ড ব্যবহারকারীর গতিবিধি আঁকানো সম্ভব। স্মার্ট মোবাইল ফোনে মানুষের অবস্থানগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পূর্ণ নির্ভুলতার সাথে রেকর্ড করা হয় যে কোনও সময়। ফোনের ডিভাইসগুলি এক থেকে তিনটি ট্রান্সসিভারের মধ্যে সংযুক্ত থাকে, এবং প্রায় ৮৬০,০০০। ৪জি এবং ৫জি ট্রান্সসিভারগুলি ঘন করে পুরো দেশ জুড়ে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফোন সংস্থাগুলি সমস্ত গ্রাহকদের তাদের আসল নাম এবং জাতীয় রেজিস্ট্রি নম্বর সরবরাহ করে থাকে ।
এর ফলে প্রায় প্রত্যেকের ফোনের অবস্থান অনুসরণ করে ট্র্যাক করা সম্ভব। আবার দক্ষিণ কোরিয়ার শহরগুলিতে ১০ মিলিয়নেরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা বা গড়ে ৫ জন প্রতি একটি ক্যামেরা আছে । ক্যামেরা কর্তৃপক্ষ কোভিড-১৯ রোগীদের সাথে যোগাযোগ করে এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করে । একই সাথে ডাটা ব্যবহার করে । কোরিয়ান নাগরিক কিম ইয়ং গিও জানান,সরকারের দ্রুত পদক্ষেপে তারা সন্তুষ্ট, ২০১৫ সালের সার্স রোগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে কোরিয়া। নাগরিকের সহযোগিতায় কোরিয়া এখন বিশ্বের মডেল। কোরিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কিম চোন জানান, কোরিয়ার এই সফলতা ও অভিজ্ঞতা অন্য দেশের জন্য সহায়তা হবে, একই সাথে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথে সংযুক্ত কয়েকজন প্রতিনিধি জানান, কোরিয়ার উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সরকারের প্রাণপণ প্রচেষ্টায়, কোরিয়া এই ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব ঠেকাতে সক্ষম হয় ।
কোরিয়ার ইনছন এয়ারপোর্টই বিশাল ডিজিটাল স্ক্রিনে লেখা আছে “করোনামুক্ত বিমানবন্দর” কোরিয়াতে করোনার প্রভাবে পণ্যের দাম বাড়েনি, মাস্কের সংকট নেই, ডাকঘর, ফার্মেসীতে পর্যাপ্ত মাস্ক রয়েছে। কোরিয়ায় পর্যাপ্ত মালামাল মজুদ রয়েছে, সমানতালে কাজ চলছে, পুরো কোরিয়াকে সরকারি উদ্যোগে জীবাণুনাশক দিয়ে ধৌত করা হয়েছে। রেল স্টেশন, বাস স্টেশন,বিমান বন্দরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরকারিভাবে রাখা হয়েছে ফ্রিতে ব্যবহারের জন্যে।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, শুধু লকডাউন করে ঘরে বসে থাকলেই হবে না । উপসর্গ আছে এমন সবাইকে টেস্ট করে প্রতিটা রোগীকে এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হবে । তারপর তাদের আইসোলেশন ও কোয়ারেনটাইন নিশ্চিত করতে হবে । নয়তো লকডাউন ও কোয়ারেটাইনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও করোনা ভাইরাস আবার ভয়াবহ আকারে ফিরে আসবে আর এভাবেই চলতে থাকবে ।