করোনার কারণে বদলে গেছে প্রকৃতি-পরিবেশ

সফি খান:
করোনার কারণে বদলে গেছে গ্রামীণ পরিবেশ ও প্রকৃতি। অনেক হারিয়ে যাওয়া প্রাণির কলতানে মুখরিত চারদিক। উদ্ভিদের সবুজ ছোঁয়ায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। যতদূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ। বৃষ্টির ছোঁয়ায় গাছপালাগুলো সজীব সতেজ হয়ে উঠেছে। ফুলে ফলে ভরে গেছে। এমন শান্ত সবুজ নিরিবিলি গ্রামীণ পরিবেশ অতীতে খুব একটা পায়নি মানুষ।
লকডাউনের কারণে মানুষ প্রায় বাড়িতে। যত্রতত্র ছোটাছুটি নেই। যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ। এই সুযোগে প্রকৃতি নিজের মত বেড়ে উঠছে। আগাম বৃষ্টিতে পুকুর, খাল, বিল, ডোবা ও বোরো ধানের জমিগুলোতে পানি জমেছে বেশ। সেখানে নিরাপদে বিচরণ করছে জ¦লজ প্রাণি। বিশেষ করে ব্যাঙ। সারাদিন ওদের ডাকে গ্রামগুলো মুখরিত। এর সাথে যোগ হয়েছে ময়না, টিয়া, কোকিল,বুলবুলি, সারস, ফেচকা, ঘুঘু, টুনটুনি, কাক, কাঠ ঠোকরা, পানকৌড়ি, মাছরাঙাসহ নানা পাখি। বাতাসে দোল খাচ্ছে শীষ আসা বোরো ধানে। শিশু কিশোরা সারাদিন বৃষ্টি ভেজা মাঠে লুটোপুটি খাচ্ছে। খেলাধুলা করছে। এরপর পুকুর, ডোবা ও নদীতে লাফ ঝাঁপ সাথে মাছ ধরছে।
অতিতে নদীর দুই পারে পানিতে শ্যাওলাসহ প্রচুর উদ্ভিদ অর্থাৎ জ¦লজ গাছ গাছালি জমে থাকতো। অনেক দিন উদ্ভিদ চোখে পড়েনি। স্থানীয় মানুষরা জানায়, এগুলোর ভিতর চিংড়ি ও মোলা মাছ লুকিয়ে থাকে। শিকারিরা সহজে হাতরে ধরতে পারে। কুড়িগ্রামে ১৬টি নদ-নদী। এ গুলোতে পানি কম থাকায় মানুষ হাত দিয়ে দল বেঁধে মাছ ধরছে। অনেকে ধরছে বরশি ও ঝাকি জাল দিয়ে। নারী,পুরুষ, শিশু ও কিশোররা গোসল করছে। অনেকে গরুকে গোসল করাচ্ছে।
ভারতের আসাম সীমান্ত সংলগ্ন কুড়িগ্রাম জেলার আইরমারীর চর। সেখানকার বাসিন্দা সহিদুল ইসলাম। পেশায় নৌকার মাঝি। তিনি বলেন ‘ভাই নদীতে আগে শুশুক কম দেখছি, এখন ম্যালা দেখা যায়। চরে কত রকম নতুন গাছ হইছে। আগে দেখিও নাই। নামও জানিনা। খুব ভালা নাগে। আগে নদীর ঘাট গুইলাতে মানুষ গমগম করতো। অহন সারা দিন বইসা থাকলেও মানুষ পাওয়া যায় না। সব কেমন জানি শান্ত হয়া গেইছে।,
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে গ্রামগুলোতে নেমে আসে অন্ধকার। শুনশান নিরবতা। গাছের পাতা মাটিতে পড়ার শব্দ কানে এসে লাগে। বাতাসের শো শো শব্দ অন্যরকম অনুভূতি জানায়। জোনাকিরা আঁধার ভেদ করে নিজের আলোয় আলোকিত করছে। সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হঠাৎ দূর কোন গ্রাম থেকে ভেসে আসে কুকুরে ডাক। একটি কুকুরের ডাকে চারিদিক থেকে সমস্বরে শুরু হয় বিকট শব্দ ঘেউ ঘেউ ঘেউ।
কেন এই অবস্থা জানতে চাইলে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের সাখাওয়াত হোসেন নামে একজন শিক্ষক জানান, আসলে বদলে যাচ্ছে গ্রামের পরিবেশ। মার্চ মাসে রৌদ্র তাপ বেশী ছিল। বোর ধানের জমিগুলোতে কৃষকরা শ্যালো মেশিনে পানি নিতো। দিন রাত শ্যালোর বিকট শব্দে প্রাণিরা দুরে থাকত। এপ্রিলে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় মেশিনগুলো বন্ধ। জমিতে পানি জমেছে। ডোবা খাল বিলে পানি জমেছে, সেখানে প্রাণিরা অবাধে বিচরণ করছে। এছাড়া লক ডাউনের কারণে গ্র্রামীণ সড়কগুলোতে যানবাহন ও মানুষের চলাচল খুব কম। শিয়াল, বাঘাশাল্লা চোখে পড়ে। প্রচুর পাখির আনাগোনা। বহুদিন এতো সবুজ চোখে লাগেনি। সন্ধ্যার পর এতোটাই নিরব হয়ে যায় পোকা মাকড়ের ভয়ে বের হতে ইচ্ছে হয় না।
তিনি আরও বলেন আমার বাড়ি দুধকুমার নদীর পারে। নদীর এমন শান্ত রুপ অনেক দিন পাইনি। তার সাথে নানা রকম উদ্ভিদে ভরে গেছে। করোনায় ঘরে থাকতে কষ্ট হলেও প্রকৃতির রুপ দেখে মনটা ভরে যায়।
কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ নুরুল আমিন খান জানান, মানুষ ঘরে থাকায়, যানবাহনের চলাচল বন্ধ হওয়ায় প্রাণিরা অবাধে বিচরণ করছে। সড়কে বের হলে শিয়াল ও বাগাশাল্যা দেখা যায়। আগে চোখেই পড়তো না। প্রকৃতিতে একটা পরিবর্তন আসছে। তিনি আরও বলেন প্রকৃতিকে বিরক্ত না করলে মানুষের জন্য অপার সৌন্দর্য মেলে ধরে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!