‘হামার গরীব মানষের ফির ঈদ কীসের?

আব্দুল খালেক ফারুক:
‘বাড়ি ঘর ভাঙি বান্ধোত আছি। তাও ভাঙবার নাগছে। কোনোটে যাওয়ার উপায় নাই। এক কেজি চিড়া ছাড়া আর কিছুই পাই নাই। হামার গরীর মানষের ফির ঈদ কীসের? ’-বন্যা বিধবস্ত সারডোব বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রিত দিনমজুর জহুরুল হক। তার পাশেই ভাঙা চালায় রাত যাপন করেন সাহেরা বানু। এক কাপড়ে একবেলা খেয়ে দিন পার করছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ভাই বানোত ভাসি যাবার ধরছিলোং। জীবনটা নিয়া কোনমতে বাঁচি আছি। ঘর দুয়োর সউগ ভাসি গেইছে। ছওয়া পোওয়া নিয়া ঈদোত হামরা কী খামো?’
রবিবার সরেজমিন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ধরলা তীরবর্তী সারডোব ও হলোখানা গিয়ে দেখা গেছে, বন্যা বিধবস্ত এক বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে এই এলাকা। শত শত একর ধানি জমি বালুতে ঢেকে আছে। পাটসহ সব ফসল নষ্ট হয়েছে। গাছপালঅ ভেঙে আটকে আছে। ধবংসযজ্ঞের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে গ্রামজুড়ে। বেশ কিছুর পরিবার ঘর ভেঙে আরডিআরএস বাজারের আশে পাশের রাস্তায় মালামাল স্তূপ করে রেখেছেন। কেউবা গেছেন উত্তর ও দক্ষিণের ভাঙা বাঁধে। গ্রামে দু একটি ডিঙি নৌকা ছাড়া যোগাযোগের কোন মাধ্যম নেই। ঝুঁকি নিয়ে বাজারে আসছেন কেউ কেউ। শত শত দিনমজুর কর্মহীন। ধার-দেনা দাদনের উপর চলছে দিন। গ্রামে কোনবানি দিবেন-এমন সামর্থ্য আর কারো নেই। তাই ঈদে এক টুকরা মাংস সন্তানদের মুখে দিবেন-এই চিন্তা এখন বিলাসিতার নামান্তর।
ঈদ উপলক্ষে সরকার কুড়িগ্রাম জেলায় ৪ লাখ ২৮ হাজার পরিবারকে ১০ কেজি করে ভিজিএফ চাল দেয়ার কথা। তিন্তু অনেক দরিদ্র বানভাসি সেই চাল পায়নি বলে অভিযোগ করেছে।
হলোখানা গ্রামের দুলাল মিয়ার বাড়ি এক রাতেই ভেঙে গেছে। ঘর ভেসে গেছে একটি। আর দুটি গ্রামবাসী ঝুঁকি নিয়ে ভাঙতে সাহায্য করেছে। এখন দু’পাশে ভাঙা একটি বাঁধে আশ্রয় নিয়ে আছেন। বলেন, শুনি বোলে সরকার অনেক সাহায্য দিবার নাগছে। হামরা কিছুইতো পাইলোং না।’ একই গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক যাদু মিয়া জানান, এক বিঘা জমি তাও বালু দিয়ে ঢাকা পড়েছে। এখন কীভাবে দিন চলছে এই নিয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন তিনি।
সারডোব গ্রামের বাসিন্দা মমিন মিয়া জানান, বানের জলে ঘর ভেসে গেছে। কিছু ঘর ভেঙে রাস্তায় রেখেছেন। খোলা আকাশের নিচে দিন রাত কাটছে। বৃষ্টিতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভিজছেন। দু’দিন ধরে শুকনো খাবার খেয়ে আছেন। সারডোবের গৃহবধূ রিক্তা পারভীন জানান, গ্রামের রাস্তাঘাট সব ভেঙে গেছে। চলাচলের জন্য নৌকাও পাওয়া যাচ্ছেনা। দাদার আমলের বসতি ভেঙে মালামাল নৌকায় তুলছেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি জানান, আপাতত মালপত্র নিয়ে বড়লই গ্রামের আত্মীয়ের শুকনো জায়গায় রাখছেন। পরে কোথায় যাবেন, সিদ্ধান্ত পরে।
সারডোবের দিনমজুর আব্দুল জলিল এক মাস ধরে আশ্রয় নিয়ে আছেন রাস্তায়। করোনা থেকে কর্মহীনতা শুরু। এখন বন্যায় আরো কাহিল হয়ে পড়েছেন। এ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকা সুদের উপর দাদন নিয়েছেন। মাসিক শতকরা ১৫ টাকা সুদ গুণতে হচ্ছে। সারডোবের দিনমজুর মর্জিনা জানান, শ^শুর শ^াশুড়িসহ ৮ জনের সংসার। স্বামী স্ত্রী কাজ করতেন। দুই মাস ধরে কাজ নেই। এনজিও উদ্দীপন এর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। এছাড়া আরো ১০ হাজার টাকা দাদন নিয়েছেন। এখন একবেলা খেয়ে চলছে দিন। কোন ত্রাণ সহায়তা না পাবার অভিযোগ তারও।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোক্তার হোসেন জানান, তার ওয়ার্ডে ১ হাজার ২০০ পরিবার পানিবন্দী । তারমধ্যে অন্তত ৮০০ পরিবারকে ত্রাণ দেয়া জরুরি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ৩৮০টি পরিবারকে ত্রাণ দেয়া সম্ভব হয়েছে। বাকীরা ধর্ণা দিচ্ছে ত্রাণের জন্য। অনেক গালি গালাজ শুনেও নিরুপায় তিনি। একই কথা বলেন ৪ নং ওয়ার্ডের মেম্বার বাহিনুর রহমান জানান, ৬৯৭টি পরিবারের মধ্যে ভিজিএফ কার্ড পেয়েছেন ৩২০টি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার ময়নুল ইসলাম জানান, তার উপজেলায় দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ৫৬ হাজার। ভিজিএফ কার্ড দেয়া হয়েছে ৬০ হাজার ২৮৭টি। সেই হিসেবে সবার চাল পাবার কথা। তারপরেও কেউ না পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!