কালের স্বাক্ষী ভিতরবন্দ জমিদারের কাচারীঘর

আব্দুল কুদ্দুস চঞ্চল:
কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ জমিদারের কাচারীঘর। ১৮শতকের শেষের দিকে ইট,সুরকি, কাঠ দিয়ে নির্মিত চারচালা বারান্দাসহ টিনের আটচালা দ্বিতল ভবনটি বর্তমানে ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
ভিতরবন্দ জমিদারির শেষ জমিদার শ্রী ধীরেন্দ্র কান্ত রায় চৌধুরী ১৮৯৯ সালে এই কাচারীঘরটি নির্মাণ করেন। কাচারী ঘরটি বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার হতো। এখানে বহুবিদ কাজ সম্পাদন করতেন জমিদার। নাট্যশালা হিসেবেও ব্যবহার হত এটি। এই কাচারীঘরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ১৮১৯ সালে নির্মিত শ্রী শ্রী গোপালজিউ মন্দির। মূল জমিদার বাড়িটি ছিলো ১৫ একর ৪২ শতক জমির উপর ১৮ কোঠা বিশিষ্ট একটি পাকা দালান, একটি কাচারী বাড়ি, তিনটি মন্দির, তিনটি দিঘি ও বাগান। জমিদার ধীরেন্দ্র কান্ত রায় চৌধুরীর পিতা জমিদার সারদাকান্ত রায় ১৮ কোঠা দালানটি ১৮ শতকের গোড়ার দিকে নির্মাণ করেন। এবং আধ্ম্যাতিক জ্ঞান লাভের জন্য তিনটি মন্দিরও নিমার্ণ করেন। প্রজাদের সুপেয় পানির জন্য খনন করেন তিনটি দিঘি।
পরবর্তিতে ১৯২২ সালে জমিদার ধীরেন্দ্র কান্ত রায় চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়িসহ ৭ একর ১৮ শতক জমি স্ত্রী প্রতিভা বালা চৌধুরানীর নামে উইল করেন এবং ৮ একর ২৪ শতক জমি মন্দিরে দেবোত্তর সম্পতি হিসেবে দান করেন। ১৯২৪ সালে জমিদার পরলোকগমন করলে প্রভাতিবালা জমিদারী চালান। ১৯৪৯ সালে জমিদার প্রথার বিলুপ্ত হলে শুধুমাত্র বাড়ি এবং মন্দিরের জমি প্রতিভা বালার দখলে থাকে। ১৯৭৬ সালে প্রভাতিবালা সমস্তকিছু দেখভালের জন্য কর্মচারী মন্তোস কুমার চৌধুরীকে দ্বায়িত্ব দিয়ে তীর্থ ভ্রমনে ভারতে যান। একমাত্র মেয়ে কনকবালার কলকাতার বাড়িতে তিনি কিছু বছরপর পরলোক গমন করেন।
এদিকে দায়িত্ব পাওয়া মন্তোস কুমার কিছু সম্পত্তি বিনষ্ট করে এবং স্থানীয়দের চাপে ১৯৮৪ সালে সপরিবারে ভারতে চলে যান। তার ভারতে যাওয়ার পরপরই ওই বছর জমিদারের বাড়ি বেদখল এবং লুটপাট হয়। ১৮ কোঠা দালানটি ভেঙেচুরে নিচিহ্ন করে একটি মহল। তবে ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায় কাচারী ঘরটি। পরবর্তিতে লাওয়ারীশ সম্পত্বি হিসেবে প্রতিভাবালার নামীয় জমি সরকার ১নং খাস খতিয়ানের অন্তর্ভূক্ত করে দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা দ্বায়ের করে। নি¤œকোর্টে সরকার পক্ষ রায় পায়। পরে দখলদার উচ্চ আদালতে আপিল করে। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে। তবে দেবত্তোর মন্দিরের জমি কিছুটা বেহাত হলেও বেশীর ভাগ রয়েছে মন্দিরের দখলেই। সরকার সেখানে একটি আধুনিক মন্দির পুননির্মাণ করেছে ২০১২ সালে। এদিকে জমিদার বাড়ির জমির কিছু অংশে ইউনিয়ন পরিষদের ভবন নির্মানাধীন রয়েছে এবং ইতিমধ্যে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মিত হয়েছে।
জমিদার ধীরেন্দ্রকান্ত রায় চৌধুরী ছিলেন একজন শিক্ষা ও সংস্কৃতি বান্ধব ব্যাক্তি। তার সময়ে ভিতরবন্ধ ছিলো শিক্ষা এবং সংস্কৃতির তীর্থস্থান। তিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য ১৯০৩ সালে এ্যডওয়ার্ড পাবলিক লাইব্রেরী, ১৯১৭ সালে ইএম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়া একটি থিয়েটার হলও নির্মাণ করেন। যা এখন বিলুপ্ত। স্থানীয়দের দাবী জমিদারের যেটুকু স্মৃতি রয়েছে তা যেন ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হয়।
ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাচ্চু জানান, ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম নতুন ভবনে নিয়ে যাওয়ার পর ২শ বছরের পুরাতন এই ভবনটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে রাখা হবে। এবং এই কাচারীঘরটিতে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা আছে। যদি বরাদ্দ পাই তাহলে কাচারীঘরটি মেরামত করে জমিদারের সকল স্মৃতি সেখানে সংরক্ষণ করা হবে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!