হ্যাট্রিক কন্যা সরলিকার স্বপ্ন আধারে নিভে গেলো – মোঃ শামীম হোসেন

কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা বাঁশজানী আমার নিজ জন্মভুমি। যেখানে আমার জন্ম,যে জায়গার মাটিতে মেশা আমার শৈশব, যে জায়গার ফলমুল,আলো,বাতাসে নিজের বেড়ে উঠা সেই এলাকার সামগ্রিক বিষয় গুলো নিয়ে সবসময় ভাবনা চলে আসে। যখন সফলতা আসে তখন কান্নায় ভাসি আনন্দের কান্না আহা! কি তৃপ্তি সেই সফলতায়। আবার যখন হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ি তখনও কান্না আসে সে কান্না শুধুই কষ্টের কান্না। এই পৃথিবীতে হাসি কান্নার খেলায় কারও জীবন হয় সফলতার কারও জীবন হয় মিছে কিছু অভিনয়ের।তবুও বেঁচে থাকার সম্ভবনাময় স্বপ্নের লড়াই। এটি ঘটনা নয় আমি দুর্ঘটনার কথাই বলবো ঘটে গেল আমাদের পল্লী গ্রাম বাঁশজানীতে। ২০১৭ সালে ১ লক্ষ ৬২ হাজার স্কুল কে টপকিয়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ফুটবল কাপ এ ৩ স্থান অধিকার করেন বাশজানী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং দেশসেরা অলরাউন্ডার খেলায়োর হিসাবে যার নাম চলে আসে সে আমাদের ভুরুঙ্গামারীর বাঁশজানীর হ্যাট্রিক কন্যা সরলিকা।

২০১৭ থেকে ২০১৮/১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ইলেকট্রনিক মিডিয়া কোথাও বাকী ছিল না সরলিকা কে নিয়ে নিউজ করা। সেই সরলিকার সম্ভবনাময় স্বপ্ন গুলো কেড়ে নিলো ২০২০ এর করোনা কালীন সময়। শুধু সরলিকা নয় সরলিকার টিমের অধিকাংশ মেয়ে খেলোয়াড়দের একই অবস্থা। বাল্য বিবাহের স্বীকার হয়েছে প্রায় ৪/৫ জন। গত সপ্তাহে সরলিকার বিয়ার পিড়িতে বসতে হয়েছে।যে মেয়েটি ২০১৭ সালে প্রাইমারীর গন্ডির পাড় করলো ২০২১ সালে তাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো।সকলের মুখে একটাই প্রশ্ন সরলিকার কি তাহলে বাল্যবিবাহ হয়ে গেল? আপসোস, ক্ষোভ, রাগ,ঘৃণা সবকিছুই এই সমাজের মানুষের কাছে সময়ের পালা ক্রমে একটা দীর্ঘশ্বাস। যে সরলিকা কে নিয়ে ২০১৭ সালে সকলেই বাহবা দিলো সেই সরলিকা কে নিয়ে এখন মানুষের ঘৃণা তৈরি হলো এটাই আমাদের সমাজের বর্তমান চিত্র। চাকরি সুবাদে আমি দিনাজপুর জেলায় কর্মরত আছি। সত্যিই যদি জানতে পারতাম যতদুরেই থাকি না কেন আমাদের হ্যাট্রিক কন্যা সরলিকার বিয়ের পিড়িতে বসাতে দিতাম না।এমনি হতভাগা আমরা আমাদের হ্যাট্রিক কন্যাকে আমরা সত্যি সত্যি হারিয়ে ফেললাম। বিয়ের এক সপ্তাহ পর যখন জানতে পারলাম রাত ১১ টার দিকে ফোন কলে কথা বললাম সরলিকার বাবার সাথে সম্পর্কে আমার চাচা সরলিকার বাবা। চাচা কে ফোন দিয়ে বললাম একি খবর শুনলাম? উনি বিষয়টি কোন লুকোচুরি না করে স্বেচ্ছায় বলে দিলেন হ্যা বিয়ে দিয়েছি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম,সরলিকার বাবার মুখে জবাবটি দিল পুরো ক্ষোভ নিয়ে আমি বুঝতে পারলাম। প্রায় ১ ঘন্টার ফোন আলাপের আলাপচারিতায় ফুটে উঠে সরলিকার স্বপ্নগুলো ভেস্তে যাওয়ার একেকটি শিঁড়ি। আমি জিজ্ঞেস করলাম চাচা এত কম বয়সী মেয়ে যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরুষ্কার গ্রহণ করলো সারা বাংলাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করলো তাকে কিভাবে আপনি এত কম বয়সে বিয়ে দিলেন? তার বাবা আমাকে উত্তর দিলো বাবা “অভাবে স্বভাব নষ্ট”। এ্যালা তো কইবেন সরলিকাকে ক্যা কম বয়সে বিয়েও দিলং? করোনার সময় আমার দুর্দশা কায় দেখপের আসছে, তুই আসছিস? তুই একবেলা চাউল কিনি দিছিস? মোর বেটির স্বপ্ন মোর চেয়ে কায়ও বেশি জানে না।মোর বেটি প্রধানমন্ত্রীর হাত থাকি যখন পুরুষ্কার আইনছে তখন সগায় আসি বাড়িত ভীড় করা শুরু করিল। সগায় আসি ছবি তুলে,ফেসবুকত দেয়, টিভিত দেখায়, কত জায়গা থাকি নাকি অনুদান আইসপে আমার বাড়িত।আর সেই বেটির করোনো কালে কায়ও খোজ নিল নে।মুই কামলা দিবের যাং কায়ও কামলাও নিবের চায় না।কি দুঃখ দুর্দশা আমার গেছে কায়ও খোজ নিবের আসিল না।পুরে ১ টা বছর আমার কত কষ্ট করি দিন গেছে কায়ও খোজ নিবের আসিলনে। তখন টিভিত দেখি ভুরুঙ্গামারীত,কুড়িগ্রামত করোনার সময় কত মানুষ অনুদান পাবার নাকচে।আমরা খালি আপচোচ করছি আমার ঘরত তো কায়ও ১ সের চাউল ও দিয়ে গেইল না।মান সম্মানের ভয়ে কাকও কংও নাই আমাক কিছু দেও। বাপরে, বেটি যার মাথা ব্যাথা তার।কার ছওয়াক কায় দেখে,মোর এত কষ্ট গেইল কায়ো আসি মোর ছওয়ার খোজ নিল না মোর বুক ফাটি কান্দন বের হইছে।পাং না কারও ওটি হাত পাতপের পাং না কাকও কবার।হামার গরীব মানুষের কায়ও নাই।যখন সরলিকা ভাল করি ফুটবল খেলাইছে তখন সগায় মেম্বার,চেয়ারম্যান,টিএনও,ডিসি, এস,পি সগায় সরলিকার প্রশংসা নিয়ে ব্যাস্ত আছিল যখন আমার বিপদ আসিল তখন কায়ও আর সরলিকার খোজ নিল না মোর সকাগে চেনা শেষ। বেটি বড় করি মানষ্যের ওটি হাত পাতিম বিয়ে দেওয়ার জন্যে টাকা চাইম। সগাকে চিনছং করোনার সময় আর কাকও চেনার বাকী নাই মোর।মুই বুঝং মোর বেটি মোক কইছে আব্বা মোক ঢাকাত ভর্তি করি দেও আমরা গরীব থাকপের নই মুই ভাল করি ফুটবল খেলি মেলা টাকা কামাই করিম বাড়িত প্রতি মাসে পাঠে দিম। কত মানুষ ভর্তি করি দেওয়ার জন্যে কথা দিয়ে গেইল ওইযে গেইল আর আসিল না। মোর বেটিক বিয়েও দিছং কোন ডিমেন্ট নাগে নাই।কম বয়সে বিয়েও দিছং সগায় তো কইবেন বেটিক বড় করলে খরচ আছে, বড় করিয়ে ডিমেন্টের টাকা ওতগুলে কোটে পাইম। তবে মুই চাং সরলিকার মত মেলা ভাল ভাল খেলোয়ার বের হইবে সগায় যখন ধনী ঘরত জন্ম নেয় আমার মত গরীবের ঘরত না। আমার মত গরীব ঘড়ত জন্মনিলে খোজ নেওয়ার কায়ও থাকপের নয়,সরলিকার মত বাল্যবিয়ে আর কারও ছওয়ার হউক এটা মুই না চাং আল্লাহ কাছত সারাজীবন দোয়া করিম। আমরা গরীব আমার কপালত তো এমন হইল, আর কোন গরীবের ঘড়োত যখন এমন ঘটনা না ঘটে সগারে কাছত মোর এটাই চাওয়া। এভাবেই যখন কথা গুলো চাচার মুখে শুনি তখন সত্যি নিশ্চুপ হয়ে গেছি। আমি আমার বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেলাম। চিন্তা করলাম সরলিকার বাল্য বিবাহের জন্য সরলিকার বাবা দায়ী নাকি আমাদের অবহেলিত সমাজ বা রাষ্ট্র দায়ী। এভাবেই প্রতি নিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের সেই মেধাবী মুখগুলো। মেধাবীদের মুল্যায়ন হলে আজ সরলিকার মত মেয়েদের বাল্যবিবাহের সম্মুখীন হয়ত হওয়া লাগতো না।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!