নুসরাত জাহান:
উসকোখুসকো চুল আর মাঝারি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সংবলিত হতাশাগ্রস্ত একজন যুবক বসে আছে। সামনেই পড়ে আছে আধখোলা খাম। তার উপরে মোটা হরফে উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা ‘বেকারের চিঠি’। নামের সাথে প্রচ্ছদের চমৎকার সাদৃশ্য। বলছি প্রগতিশীল লেখক আব্দুল খালেক ফারুক রচিত ‘বেকারের চিঠি’ উপন্যাসের কথা। সাম্প্রতিক সময়ে বিরাজমান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হল ‘বেকারত্ব’। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অহরহ বেকারত্বের গ্লানি বয়ে বেড়ানো তরুণ সমাজের হা-হুতাশমূলক অনুভূতি চোখে পরে। এই সময় দাঁড়িয়ে এমন শিরোনামওয়ালা বই হাতে পেলে কার না পড়ার আগ্রহ জাগে?
“বড় সাইনবোর্ড দেখে ইতু ভেবেছিল, অফিসটা বড়ই হবে। দৈনিক পত্রিকার অফিস, বড়ই হওয়ার কথা! সম্পাদক সাহেব নিশ্চয়ই বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তি। সম্পাদক মানেই তো বিশাল ব্যাপার। ” [পৃষ্ঠা ৭ ]
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ইতু নামক একজন বেকার যুবকের একটি পত্রিকা অফিসে ঢোকার এমন পূর্বধারণা দিয়ে কাহিনীর শুরু। যার পুরো নাম ইলতুৎমিশ। তবে না, সে কোন ইন্টারভিউ দিতে কিংবা চাকুরির খোঁজে এখানে আসেনি। সে এসেছে ‘চাকুরি চাই’ বিজ্ঞাপন দিতে। শুনতে হাস্যকর হলেও এটাই সত্যি। ‘পাত্রী চাই’, ‘টিউশনি চাই’ —এই টাইপের বিজ্ঞাপন ‘চাকুরি চাই’। সম্পাদকের সাথে কথা বলবার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় পত্রিকার পুরনো সংখ্যায় চোখ বুলানোর সময় ‘কুকুরের ভয়ে ফজরের নামাজ পরতে গিয়ে বেকায়দায় মুসল্লিরা’, ‘পৌরসভার ড্রেনে কৃমির উৎপাত’ —টাইপের ষোলআনা বিনোদন সংবলিত হেডিং যেন বর্তমান সময়ের কিছু কিছু সংবাদ পরিবেশনাকেই ইঙ্গিত করে। অতঃপর সম্পাদকের চাহিদা ‘কলাম ইঞ্চি দুই হাজার টাকা’ শুনে ফেইসবুকে স্টাটাস দেবার ভয় দেখিয়ে, লাঠির তাড়া খাবার হুঙ্কারে অনেকটা হাস্যরসাত্বক ভাবেই প্রস্থান।
মোড়ের দোকান থেকে পাড়ার সমস্ত সংবাদ ছড়ানোর চিরায়ত দৃশ্য এখানেও উপস্থাপিত হয়েছে দোকানী রমজান ভান্ডারির মাধ্যমে। ‘খানা হালাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ এর মালিক মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়ার সাথে ইতুর কথপোকথনে উঠে আসে চাকুরি ক্ষেত্রে কোটা প্রসঙ্গ। সরকারের কোটা পদ্ধতি তুলে নেওয়ায় তার চিন্তিত অবয়ব দেখে ইতু বলে,
“আপনি এত চিন্তা করেন ক্যান। আপনার সব ছেলেমেয়ের তো চাকরি হয়েছে। এখন কোটা থাকল না গেল তা নিয়ে এত চিন্তা ক্যান?”
উত্তরে তিনি বলেন,
“এই যে বোকার মত কথা কও। ছোট ছেলেটা তো কেবল রিটেন দিল”।
তিনি আরো বলেন,
“ছেলেমেয়ে শ্যাষ হইলে কী হইব? নাতি—নাতনি আছে না? তাদের একটা গতি কইরা না যাইতে পারলে কবরে গিয়া শান্তি পামু? পরওয়ারদিগারকে কী জবাব দিমু কও? যা দিনকাল পড়ছে।”
অধিকাংশ পিতামাতাই সন্তানকে পড়াশোনা করান, বড় করেন একটা চাকুরী পেয়ে পরিবারের হাল ধরবে এই আশায়। কিন্তু এ দেশে চাকুরি যে সোনার হরিণ। আর এ সোনার হরিণের দেখা না পাওয়ায় কত মধ্যবিত্ত পরিবারের আনন্দঘন পরিবেশ যে হারিয়ে যায় সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইজি চেয়ারে চিন্তামগ্ন বাবার বসে থাকা কিংবা ক্লান্তির ছাপযুক্ত মায়ের মুখে এই হতাশার ছাপই যেন ফুটে ওঠে। বাবা এবং তার বন্ধু শামসুল চাচার সাথে ইতু যায় এলাকার এমপি সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেখানকার ঘটনাবলিতে পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয় ক্ষমতাসীন নেতাদের অন্দরমহলের দৃশ্য। বিনে পয়সাতে চাকুরি দেবার লেকচারের সাথে তার সহকারী বজলুর সাথে দেখা করতে বলেন এমপি সাহেব। ডিমান্ড দশ লাখ টাকা। বাবা কিছু কমানোর জন্য ডিমান্ড করলেও বজলু নাছোড়বান্দা। বলে, অনেকে বারো লাখ নিয়ে ঘুরছে। সে এনাদের একটু কমিয়ে দিয়েছে।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গাজা—ইয়াবা ব্যাবসার সাথে যুক্ত স্কুলজীবনের বন্ধু চেঙ্গু হালিমের সাথে হঠাৎ দেখা হওয়ার সুবাদে কয়েক মুহুর্তেই ইতুর ঝুলিতে যুক্ত হয় নতুন অনেক অভিজ্ঞতা। বাসায় জরিনা খালার নিয়ে আসা বিয়ের প্রস্তাব। যেখানে শশুরের ধনসম্পদ প্রাপ্তির সাথে রয়েছে চাকুরির সুবর্ণ সুযোগ। সবমিলিয়ে ‘একের ভিতর অনেক’ —টাইপের লোভনীয় অফার। মজার ছলে খালাকে বিদায় করলেও নিরব কান্না জমাট বেধেছিল ইতুর বুকে।
অবশেষে শামসুল চাচার সুবাদে একটা ক্লিনিকে সাময়িক অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের চাকুরি জুটলেও সেই আশার আলো খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগে পুকুর চুরির খবর তো নতুন না। সৎ মানসিকতা সম্পন্ন ইতু কতক্ষণই বা সেখানে টিকতে পারে! চাকুরির প্রথম দিনেই অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত টেস্ট দেবার কারনে ডাক্তার এবং চেম্বার থেকে বের হওয়ার পর রোগীদের অযথা হয়রানি করানোর জন্য রিপ্রেজেন্টেটিভদের সাথে বিরূপ আচরণের পর দিনশেষে মালিক তাকে বলে,
“তোমাকে রাস্তায় নামতে হবে বাবা। আমি দুধ—কলা দিয়ে কী সাপ পুষব?”
ইতু ঠান্ডা মেজাজে খুব চমৎকার করে উত্তর দেয়,
“জি না। আপনি সর্পরাজ হয়ে বীন বাজিয়ে সাপুড়ে সাজেন, আর সাপের বিষ নামান; অথবা মনষার জারি গেয়ে মজমা বসান, তাতে আমার কিচ্ছু আসে—যায় না। আমি আপনার মত গরিবের রক্তচোষা অসৎ মালিকের চাকরি করছি না। গুড বাই।”
অবশ্য চাকুরি যাবার ব্যাপারটা আগেই আন্দাজ করেছিল সে।
এদিকে ইতুর এমন চাকুরি ভাগ্যের কারণে অস্থির মায়ের মন। তিনি ইতুকে তার ফুপা মাওলানা খোয়াবপুরির তাবিজ নেওয়ার পরামর্শ দেন। ইনি আবার ‘ইউটিউব হুজুর’ নামে পরিচিত। মানে ইউটিউবে এখন এই হুজুরের ওয়াজ ভাইরাল। যার কারণে ডিমান্ডও সেইরকম। মায়ের কথা রাখতে ফুুুুপুর বাড়িতে গেলে ঘটনা পরম্পরায় উন্মোচিত হয় ইউটিউব হুজুরের নেপথ্যে লুুকিয়ে থাকা ভন্ডামি। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধর্মকে অপব্যবহার করে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চিত্রায়ণ। এক রাজনৈতিক নেতার উপস্থিতিতে রাজপথে সৃষ্ট হাঙ্গামার জেরে জেলে যেতে হয় ইতুকে। অবশ্য ছাড়াও পায় সে। তবে থানায় আসামীতে হাজতে পাঠােনোর সময় প্রথম বিভাগ ফুটবলের বাছাইয়ের সঙ্গে তুলনায় বিশেষ ইঙ্গিত মেলে।
উপন্যাসে প্রেম থাকবে না, তা কি হয়! পুরো কাহিনী জুড়ে এই বেকার যুবকটির প্রেমে পাগল প্রায় তরি নামক এক তরুণীর উপস্থিতি উপস্যাসটিকে আর রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। শুরুর দিকে বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়ানো ইতু অনিচ্ছা সত্ত্বেও তরিকে অবহেলা আর উপেক্ষা করলেও পরবর্তীতে দৃশ্যপট বদলে যায়। কিন্তু চাকুরি নামক সোনার হরিণের দেখা আর মেলে না। অবশেষে ইতুর কণ্ঠে মনিভূষণ ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত ‘বেকারের চিঠি’ কবিতাটি আবৃত্তির মাধ্যমে উপন্যাসটির পরিসমাপ্তি ঘটে। সহজ, সরল সাবলীল ভাবে ইতুর চরিত্রে এ যেন সাম্প্রতিক বাংলাদেশ—অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
লেখক আব্দুল খালেক ফারুক পেশায় একজন কলেজ শিক্ষক। সাংবাদিকতার সাথেও জড়িত দীর্ঘদিন থেকে। পেশাগত কারণেই তাকে ছুটে যেতে হয় প্রান্তিক মানুষের কাছে। খুব কাছ থেকে অবলোকন করার সুযোগ হয় সমকালীন বিরাজমান সামাজিক সমস্যাগুলো। এরই প্রেক্ষিতে রচিত উপন্যাস ‘বেকারের চিঠি’। এ যেন রম্যতার ছলে চেনা বাংলাদেশকে নতুন করে চিনে নেওয়ার অনন্য প্রয়াস।
এনামুল হক কতৃক ‘চমন প্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মাঝি বাঁধন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম প্রকাশিত বইটির মুদ্রিত মূল্য ১৯০ টাকা।
মোছাঃ নুসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ
অনার্স ৩য় বর্ষ (ইংরেজি বিভাগ)