গ্রন্থ আলোচনা : আব্দুল খালেক ফারুকের গল্পগ্রন্থ লকডাউন -জরীফ উদ্দীন

আব্দুল খালেক ফারুকের প্রকাশিত দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ লকডাউন। এতে রয়েছে ৬টি গল্প। গল্পগুলো সমসাময়িক ঘটনার প্রতিফলন। প্রতিটি গল্প পড়তে পড়তে মনে হবে আমাদেরই জানাশোনা কিংবা চোখের সামনে দেখা ঘটনা। প্রতিটি গল্পের চরিত্রগুলো আমাদের খুব কাছ থেকে দেখা কিংবা আমরা নিজেই।
প্রথম এবং নাম গল্প ‘লকডাউন’। করোনা কালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ এটি। টিভি থেকে শুরু করে ফেসবুক সবখানেই শোনা যায় লকডাউন। এই লকডাউন দেখা অনেকের শখ। তাদের দলের একজন মজনু মিয়া। এই মজনু মিয়ার চোখে দেখা যায় বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার করোনা পরিস্থিতি। এই গল্পে লেখক আব্দুল খালেক ফারুক কুড়িগ্রামসহ সারা বাংলাদেশের করোনাকালীন দিনলিপি, কুড়িগ্রামের করোনার সংবাদ, চোর—পুলিশ খেলা রম্যভাবে সুচতুরভাবে ফুটে তুলেছেন।
দ্বিতীয় গল্প এক লোভী সরকারি কর্মকর্তার করোনা রেজাল্ট তদবীর করে পজেটিভ করার গল্প। বাহ্যিক কারণে লোকটিকে লোভী মনে হলেও তিনি বাংলাদেশের নিরুপায় শ্রেণির জনগণ। এই গল্পে পাওয়া যায় একজন সরকারি চাকুরিজীবীর সন্ধান। যে করোনা পজিটিভের অনুদানের টাকা দিয়ে বাড়ির ছাদের কাজ শেষ করবেন। তিনি এই কাজ ঘুষ খেয়েও করতে পারতেন। “আরে হেয়ালি রাখ। খবর ভালো। আমার করোনা পজিটিভ।” মোবাইলে বলা এই সংলাপটাতেই সুখবরের সন্ধান পাওয়া যায়। মানুষকে পজিটিভ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
লেখক বিভিন্ন কারণে প্রায় ঢাকা যান। একদিন কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা যাবেন। কুড়িগ্রামে শাটল ট্রেনে করে গিয়ে কাউনিয়ায় রংপুর এক্সপ্রেসে ঢাকা। কুড়িগ্রামের জন্য টিকেট বরাদ্দ কম। আছে টিকেট নেওয়ার ঝামেলা। কিভাবে টিকিট কেটে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা গেলেন তার বিস্তর বর্ণনা “কুড়িগ্রাম—টু—ঢাকা” গল্পে পাওয়া যায়। যদি আপনি আন্তনগর ট্রেন যাত্রী হয়ে থাকেন। তাহলে মনে হবে এই গল্পটি আপনার।
চার নম্বর গল্প “কোব্বাত আলীর খাঁচা”। এই গল্পে লেখক গার্মেন্টস মালিক ও কর্মচারিদের সম্পর্ক, চরিত্র, মালিকদের ব্যবহার ইত্যাদি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেন। যা প্রশংসার দাবীদার। সেই সঙ্গে একজন মানুষ ক্ষমতা দেখিয়ে কি করতে পারেন এবং ক্ষমতার কারণে চারপাশ কিভাবে নিজের আয়ত্বে রাখেন তা লেখক তুলে ধরেছেন। এই ক্ষমতার দাপটের বিপরীতে অধিনস্ত ব্যক্তিদের কিভাবে বিড়াল করে রাখেন এবং কেউ প্রতিবাদ করেন না, তা তুলে ধরেছেন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ধরলার আশেপাশের গ্রামগুলোতে ডাকাতের উৎপাত বেড়ে গেলে চেয়ারম্যান কিভাবে সাইল্ল্যা মামুদ নামে এক সাহসী ব্যক্তির মাধ্যমে গ্রামকে ডাকাত মুক্ত করেন তার বিবরণই “ধরলার জলে ডাকাতেরা” সাদুল্ল্যার উপর চেয়ারম্যান দায়িত্ব দিলে জীবনের ঝুকি নিয়ে গুরুদায়িত্ব পালন করেন তার দলসহ খেয়ে না খেয়ে। ডাকাত ধরার পর ডাকাতকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়। ডাকাতের উৎপাত এক সময় বন্ধ হয় মানুষ শান্তিতে বাস করে। শুধু শান্তি নাই সাইল্ল্যার। যে জীবন একদিন দিতে প্রস্তুত ছিলেন সেই জীবন বাঁচাতে হয় রিক্সা চালিয়ে।
বরাবরই সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন আব্দুল খালেক ফারুক। তিনি ‘মায়াবী জননী’ গল্পে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন একটি পরিবারের দুঃখগাঁথা। শহিদুল নামে এক জন্মান্ধ ব্যক্তি সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে এবং খেতে দিলে খায়। সেই খাবারো জোটেনা তিন বেলা তার মা মেহরুনের ভিক্ষার পাত্রে। শহিদুলের ছেলে দোকানে থেকে যা পায় তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। মেহরুন ভাতার জন্য অনেক চেষ্টা করে টাকা দিতে না পারায় তাও ভাগ্যে জোটে না। গল্পটিতে একজন মায়ের ভালোবাসা ফুটে ওঠে।
গল্পগুলো শেষ হয়েও শেষ হয় না। কিংবা শেষ হয় থেকে যায় রেশ। এটাই গল্পকার আব্দুল খালেক ফারুকের যাদু। তিনি এই গল্পগ্রন্থে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ “কাঁটাতারে ঝুলে আছে ফেলানী” গল্পের পুনরাবৃত্তি না করেও সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। যা প্রশংসার পাওয়ার যোগ্য।
লেখক তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গল্পের সংলাপ কুড়িগ্রামের ভাষা ব্যবহার করেন যা পাঠকের ভিন্ন স্বাদ উপভোগ করতে সাহায্য করবে। সব মিলে একটি চমৎকার গ্রন্থ “লকডাউন”। যার প্রতিটি গল্পে রয়েছে ভিন্ন স্বাদ। গ্রন্থটি সবাই পড়ার আমন্ত্রণ।
বইটি প্রকাশ করেছে চমন প্রকাশ। মুল্য—১৮০টাকা।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!