দাসিয়ারছড়ায় বাসকপাতার চাষ

সাইমুল ইসলাম সাজু:
কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অধুনালুপ্ত দাসিয়ার ছড়ার কাঁচাপাকা ৮ কিলোমিটার সড়কের দুইধারে বাসকপাতার সৌন্দর্য দেখলেই মন ভরে যায়। ছবি তুলতে ইচ্ছে করে। অপরিচিত কেউ দাসিয়ার ছড়ায় আসলে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলে চলে যায়।
ফুলবাড়ী উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দুরে দাসিয়ার ছড়া। আগে ভারতের একটি ছিটমহল হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১৫ সালে স্বাধীনতা ফিরে পায় দাসিয়ার ছড়ার বাসিন্দারা। তারপর থেকে সরকার তাদের উন্নত জীবন ও আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপক উন্নয়ন করে। যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে ঔষধি গাছ বাসকের গাছের সারি চোখে পড়ে।
স্বপ্ন প্রকল্পের ১৭ জন নারী কর্মী ১০ বছরের জন্য বাসকপাতার লিজ নিয়েছেন। তাদের অনেকে বাড়ির আশে পাশে খোলা জায়গায় বাসক চাষ করে বাড়তি আয়ের উৎস খুঁজে পেয়েছেন। সড়কের ধারে ঔষধি গাছ বাসকের চাষ করে বাড়তি আয় করছেন তারা। তাঁদের চাষ করা ঔষধি বাসকপাতা কিনে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন নামকরা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
দাসিয়ারছড়ার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালের শেষ দিকে দাসিয়ারছড়ায় রাস্তার ধারে ১৮ হাজার বাসকের চারা রোপণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন। ৮ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে, বাড়ির আনাচে—কানাচে ও পতিত জায়গায় বাসকের চারা রোপণ করেন উদ্যোক্তরা। এক বছরের বেশি সময় পর প্রথম পাতা সংগ্রহ শুরু হয়।
প্রথমবার বাসকপাতা ১১ হাজার টাকা বিক্রি করেন। ৪ মাস পর দ্বিতীয় দফায় ৩১ হাজার টাকার বাসক পাতা বিক্রি করেন। এখন প্রতি কেজি শুকনো বাসক পাতা ৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ১৭ জন স্বপ্ন প্রকল্পের কর্মীদের যৌথ একাউন্টে টাকা জমা করা হয়। বাসকপাতার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা থাকলেও অনেকে এর ঔষুধি উপকারিতা না জানার কারণে আগাছা ভেবে উপড়ে দেন। একারণে ১৮ হাজার চারার মধ্যে এখন অর্ধেকের কম চারা রাস্তার ধারে চোখে পড়ে। ঠিকমত দেখাশোনা করার লোক না থাকায় এবং এর ওষুধি উপকারিতা না জানায় অনেকে বাসকগাছ কেঁটে সেখানে উদ্ভিদ গাছ লাগাচ্ছেন। যার ফলে বাসকগাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
স্বপ্ন প্রকল্পের ইউনিয়ন ফেসিলেটর মোছা.হেলেনা খাতুন বলেন , চার মাস পরপর বাসকের কাঁচা পাতা সংগ্রহ ও গাছ পরিষ্কার করতে হয়। এরপর দু—তিন ঘণ্টা বিরতি দিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে পাতা শুকাতে দিতে হয়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছ থেকে তিন মাস পরপর চার কেজি কাঁচা পাতা পাওয়া যায়, যা শুকিয়ে হয় এক কেজি। প্রতি কেজি বাসক পাতা ৩৮ টাকা দরে বিক্রি হয়। তিনি বলেন, কিছু মানুষ এই গাছের উপকারিতা না জেনেই কেটে ফেলছে। এ কারণে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশীদ জানান, ছোট থাকতে অনেক বাসকচারা নষ্ট হয়েছে। এখন সবাই পরিচর্যা করে। বাসকের পাতায় কিছুটা দুর্গন্ধ থাকায় পশুরা তা খায় না। কেউ যদি স্বেচ্ছায় বাসকগাছের ক্ষতি করে তাহলে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জানা গেছে, বাসকপাতা একপ্রকার ভেষজ ঔষধি পাতা গাছ। বাসকপাতা দিয়ে তৈরি হয় কাশির সিরাপ। বাসক একটি ভারত উপমহাদেশীয় ভেষজ উদ্ভিদ। এ উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম ঔঁংঃরপরধ ধফযধঃড়ফধ। ভারত উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র এটি জন্মে। হিন্দীতে এক বলা হয় ‘আডুসা’, ‘বানসা’ অথবা ‘ভাসিকা’। বাসকপাতা অনেকের কাছে ফেলনা মনে হলেও ভেষজ চিকিৎসায় এর জুড়ি নেই। বহুকাল থেকে ঠান্ডা—কাশির চিকিৎসায় ওষুধ হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে কুড়িগ্রামে বাসকের বাণিজ্যিক চাষ নেই বললেই চলে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বাসকপাতার যে চাহিদা রয়েছে তার ১০ ভাগ দেশ থেকে যোগান দেয়া হয়। বাকি কাঁচামাল পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ জানেই না বাসকগাছের ঔষধি ও বাণিজ্যিক মূল্য।

ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘রাস্তার ধারে উদ্ভিদ গাছের পরিবর্তে ভেষজ বা ওষুধি গাছ লাগালে আয় হবে, পরিবেশ ভালো থাকবে এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে। তিনি আরো বলেন, বাসকপাতার অনেক সম্ভাবনা আছে। কেউ যদি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে চায় আমরা তাদের সহযোগিতা করবো।”

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!