বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিপক্ষ মমতার ইমেজ

পার্থ সেনগুপ্ত, কোলকাতা থেকে:

প্রায় একমাস ধরে রাজ্য ৮ দফা নির্বাচনের প্রায় শেষদিকে চলে এসেছে। এবারের নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সর্বশক্তি নিয়ে বিজেপি এর পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে অবতরণ। মমতা ব্যানার্জী একবার বলেই ফেলেছিলেন যে, অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদি দিল্লি থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা শুরু করে দিয়েছেন। সাথে আছে বিজেপির শীর্ষ স্থানীয় নেতা এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মমতা ব্যানার্জী এবং তার দল তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি), এই যুদ্ধের মোকাবিলায় নেমে পড়েছেন। এর সাথে আছে সিপিএম, কংগ্রেস ও আইএসএফ নিয়ে গঠিত সংযুক্ত মোর্চা।

নির্বাচনের আগে থেকে তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে দেয়া শুভেন্দু অধিকারী এবং ওনার বাবা, বা আরো কিছু ছোট বড় নেতার টিএমসি থেকে বিজেপিতে যোগদান নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা টিএমসির অন্দরমহলের  অনেক খবর শুভেন্দু এবং তার বাবা শিশির অধিকারীর  জানা আছে। তাই ওনাদের পক্ষে কৌশল ঠিক করতে বিজেপির কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। পুরো শক্তিতে নেবে, টিএমসি এর দুর্নীতি সমস্ত দলের একটা মুখপত্র হয়ে উঠেছে নিজেদের আক্রমণের শাণ দিতে। টিএমসি এর আর্থিক দুর্নীতি সর্বজনবিদিত। এমনকি মমতাও জানেন। ওনার চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি, যাতে এরকম ঘটনা না ঘটে। কিন্তু নেত্রীর পক্ষে সব কিছু সামাল দেওয়া সম্ভব নয়, কেননা টিএমসি পার্টিটা চলে শুধুমাত্র নেত্রীর কথায় এবং প্রচারে ওনাকেই দেখা যায়। অন্যান্য যে নেতা বা নেত্রীরা আছেন- বিধানসভার ২৯৪টি আসনের জন্য, সেটা বোঝা যায় যে মমতা ছাড়া দলের মধ্যে একটা সামগ্রিক নেতার অভাব আছে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে। তার উপর আছে দলের মধ্যে প্রকাশ্য কোন্দল, যা বিরোধী দলগুলো হাতিয়ার করে নিয়েছে। টিএমসি এর প্লাস পয়েন্ট যতটা সম্ভব ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নেয়া, এটা আবার অনেকটা দুমুখো করাতের মতো কাজ করে। সেজন্য এবারের নির্বাচনে এই প্রথম মুসলমান প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দলটি আদিবাসী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ায়। টিএমসির একটা অপবাদ আছে মুসলমান তোষণ রাজনীতি, সেই থেকে বিজেপির সাথে যাতে সমানে সমানে টক্কর নেয়া যায় তাই এই পথ অবলম্বন।

সাম্প্রদায়িক বিভাজন বিজেপির তুরুপের তাস। পশ্চিমবঙ্গে যা আগে ছিল না, তা এবার প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। লোকে এই ফাঁদে পড়ে নিজের বিপদ ডেকে আনছে। সেটা ভোটাররা কতটা বুঝেছেন- সেটা ২ মে ফল প্রকাশের পর বোঝা যাবে।  আর আছে বিজেপির ভোট পাওয়ার জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। ঢালাও প্রতিশ্রুতি। বিশেষ করে নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপির দ্বিচারিতা, কখন বলছে এনআরসি হবে আবার কখন বলছে এনআরসি হবেনা, এটা মমতার সৃষ্টি।  কেন্দ্রীয় সরকারের ঢালাও প্রতিশ্রুতি সেই ২০১৪ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ দেখে আসছে। ভোট পাওয়ামাত্র ওনাদের প্রতিশ্রুতি শেষ হয়ে যায়। টিএমসি এর দুর্নীতি বিজেপির প্রধান অস্ত্র, বিশেষ করে মমতার ভাইপো অভিষেকের উপর টিএমসির ভেতরের একটা বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর আচরণ বিজেপির হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

সংযুক্ত মোর্চা হয়তো আশাতীত ভাল ফল করবে না। সেটা সবাই বলছেন, কিন্তু ভোটের রাজনীতি অন্য জায়গা। বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে অনুমানের সাথে হিসেব মিলছে না। এবার মৌলবাদী গোষ্ঠী আইএসএফ -এর বাম মোর্চায় অন্তর্ভুক্তি, বাম সমর্থক জনগণ ভালোভাবে মেনে নিচ্ছে না। কয়েকমাস আগে আব্বাস সিদ্দিকের এক মহিলা এমপিকে অশালীন মন্তব্য, অথবা ফ্রেঞ্চ স্কুল টিচারের প্রতি মৌলবাদীদের উস্কানিতে আব্বাসের সমর্থন-  এগুলো বাম বা নন-বাম জনতা ভাল ভাবে মেনে নিছে না, যেটা সংযুক্ত মোর্চার একটা বড় অন্তরায়। আরেকটা বড় অন্তরায় বামগোষ্ঠীর দেরি করে এই তিন দলের সংযুক্তিকরণ। কংগ্রেসের কিছু সিট নির্দিষ্ট মালদহ বা মুর্শিদাবাদে। এর বাইরে তারা যে আশাতীত কোন ফল করতে পারবে না, সেটা কংগ্রেসও ভালো করে জানে। এবারের উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে তরুণ উচ্চ শিক্ষিত ছাত্র নেতাদের বাম প্রার্থী হওয়া, যেটা সবার নজর কেড়েছে। হয়তো এটা বামপন্থীদের একটা আলাদা স্থান দিতে পারে।

কী হলো আর কী হলো না, সেটা ২ মে জানা যাবে। ভোটের আগে বিজেপি সরকারের প্রতি জনগণের যত উৎসাহ ছিল, দিন যত এগুচ্ছে, লোকের মধ্যে এবং বিজেপির পার্টি সমর্থকদের মধ্যে বিজেপির প্রতি হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি সাধারণ মানুষের জন্য কষ্ট। সেটা ভোটের ফলাফলের প্রতিফলনে কতটা দেখা যাবে, তার জন্য সমস্ত ভারতবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। সংকীর্ণ ধর্মের রাজনীতিতে মানুষ ক্লান্ত, তাদের একটাই দাবি- কর্মের প্রয়োজন, সাথে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি থেকে রেহাই।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!