করোনায় কেরামতি

সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও চলছে থেমে থেমে। বৈশাখের শেষে এসেও ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। শুক্কুর আলী রিস্ক না নিয়ে শার্টের উপর একটা পাতলা সোয়েটার পরে রওয়না হলেন পৌরসভা ভবনে। মেয়রের সঙ্গে দেখা করা জরুরি।
শুক্কুর আলী ভ্যান চালান। লকডাউনের কারণে মাল পরিবহন কম হয়। তাই ভ্যানের ভাড়া কম। কিন্তু চালের দাম বাড়ছেই। সামান্য আয়ের কুলাতে পারেন না। ঈদ উপলক্ষে সরকার অন্যান্য বছর ১০ কেজি চাল দিলেও এবার দিচ্ছে ৪৫০ টাকা করে। কিন্তু শুক্কর আলী যে বস্তিতে থাকেন, সেখানে ১৬০ পরিবারের মধ্যে মাত্র ১৬ জন এই টাকা পেয়েছেন। এমনকি বস্তির ভিক্ষুক, অসুস্থ আর বিধবাদের কয়েকজনের ভাগ্যেও জোটেনি এই টাকা। তাই হা হুতাশ করে মরছে মরছে তারা। মেয়র—কমিশনারের কাছে ধণার্ দিচ্ছেন কেউ কেউ।
শুক্কুর আলী পৌরসভায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই দেখল, ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে আসছেন মেয়র। সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়াতেই—মেয়র জিঙ্গেস করলেন—কীরে শুক্কুর কী খবর?
—ভাই মুই টাকা পাও নাই। বস্তির বেশিরভাগই পায় নাই। রুজি রোজগার নাই। এলা ঈদোত খামো কী?
—আরে পাগলা এটা ফাস্ট কেলাস পৌরসভা। ভিজিএফ—টিজিএফ দেওয়ার নিয়ম নাই। ডিসি সাইবোক অনুরোধ করি ৫ হাজার নাম লিস্ট করছি। দরকার ১০ হাজার। তা সগাই পায় কেমন করি?
—কথা ন্যায্য। কিন্তুক সরকার হামার গরীব মানষের জন্যতো এইগলা পাঠায়, হামরা পাই কই। গেলো বার করোনার ২৫শ টাকা দিলে—তাও পানুংনা। সরকার কী মোর নামটা লিস্টি থাকি কাটি দিছে নাকি ভাই।
—আ! অবুঝের মতোন কথা কইস। আরে ধৈর্য্য ধর। একটা ব্যবস্থা হইবে।
—ওগলা ভিজা গামছা বুকোত না দেন ভাই। মুই ২০ বছর থাকি ঠেলাগাড়ি চলাং। তোমরা হামার নেতা আছিলেন। বুকোত হাত দিয়া কনতো, এই ২০ বছরে হামার কী উন্নতি হইল। থাকি বস্তিত। তাকো ভাঙি দিবার চায়।
—কু প্যাচাল বাদ দিয়া বাড়ি যা। তোর রোজা নাগছে। রাইতো আসিস—দেখি কী করা যায়।
—তোমরা পাগলা হইলেন নাকি। শোনেন নাই, রাইতোত করোনা বেড়ায়। মোর বউ রাইতোত বাড়ি থাকি বের হবার দেয়না।
—মানে—কাই তোক এইগলা কইছে।
—আরে দেখেন নাই? দোকানপাঠ ৫—৬ পর্যন্ত খোলা রাখার সরকারি হুকুম। তারপর বন্ধ। মুই শুনছোং রাইতোত করোনা বের হয়। মার্কেটোত যায়য়া দেখো কী হুড়াহুড়ি বাজচে।
—তুই একটু বেশি বুঝিস। যা। মোর তাল আছে।
মেয়র গাড়িতে চড়ে দ্রুত চলে যান। হয়তো কোন জরুরি কাজ আছে।
মিশন ফেল হওয়ায় শুক্কুর আলীর শরীর অবস হয়ে আসে। ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে বাস টার্মিনালের কাছে আসেন। টার্মিনালের উত্তরে বেঞ্চে বসে কয়েকজন তুমুল আলোচনা করছে। শুক্কুর আলী কান পাতে—বিষয়টা কী?
একজন মুরুব্বির সঙ্গে তুমুল তর্ক এক মাঝবয়সী যুবকের। মুরুব্বি সরকারপন্থি। তাই সাফাই গাইছে সরকারের। যুবক মারমুখি। রক্ত মনে হয় টগবগ করছে।
—আরে চাচা আর কত সহ্য করি কন। পেপারে দেখেন নাই—একটা ট্যাবলেটের দাম এক হাসপাতাল কেনে ৯৪ পয়সায়, আর অন্য হসপিটালে ১৬ টাকায় কেনে কেমন করি? এটা কী মগের মুল্লুক? এই করোনার কতা কয়া কত হাজার কুটি টাকা লুট করলে কনতো?
এসব রাজনীতির আলাপে মাথা ধরে শুক্কুর আলীর। চরে যে ভাই থাকে তার, সেও খবর দিয়েছে— ট্যাক্সের নামে চেয়ারম্যান মেম্বাররা ১০০ টাকা করে আদায় করছে। সাড়ে ৪শ টাকায় একশ টাকা ঘুষ। বয়স্ক ভাতার জন্য গ্রামের অনেকেই অনলাইনে আবেদন করেছে। তারপরেও নাকি চৌকিদার—দফাদার—মেম্বার—চেয়ারম্যানদের হাত থেকে নিস্তার মিলছেনা। কালেকশন চলছে। সরকারি ঘর, ৪০ দিনের কাজ, রিলিপ—স্লিপ, গর্ভবতি ভাতা, পুষ্টি ভাতা—হরেক ভাতার নামে সমানে কালেকশন চলছে। পাবলিক এবার ভালোই বিপদে পড়ছে। শুক্কুর আলী ভাবেন—করোনায় কত রকমের কেরামতি চলছে—তার খবর নেয় কে?

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!