কাঁঠালবাড়ি গণহত্যা : পাকবাহিনীর বর্বরতার স্মৃতি কাঁদায় শহীদদের স্বজনদের

আব্দুল খালেক ফারুক:
পাকবাহিনীর বর্বরতার কথা মনে করে আজও শিউরে ওঠেন সুরতজন বেগম। বুকভাঙা কান্না আর হাহাকারে ব্যক্ত করেন সেই দু:খগাথা। তার নিরপরাধ স্বামী আজিম উদ্দিনকে গুলি করার পরে ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় মরদেহ। আজিম উদ্দিন ছিলেন একজন সামান্য চায়ের দোকানদার। কী এমন অপরাধ করেছিল যে, গুলি করে হত্যার পর আগুন জ্বালিয়ে তাঁর মরদেহ পুড়িয়ে দেয় পাকবাহিনী? এই প্রশ্নের উত্তর আজও পাননি সুরতজন বেগম।
কাঁঠালবাড়ী গণহত্যায় এমন অনেক বর্বরতার ঘটনা ঘটেছে। বিচার আর স্বীকৃতি না পাওয়া শহীদ পরিবারের সদস্যরা আজও বেঁচে আছেন কষ্ট আর হতাশা নিয়ে।
১৯৭১ সালের ৯ জুন। কুড়িগ্রাম শহর থেকে ৮ কি.মি. দুরে কাঁঠালবাড়ি বাজার ও আশেপাশের ৬টি গ্রামে পাকবাহিনী দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। ৫ হত্যা করে ৩৫ জন নিরপরাধ বাঙালিকে। সেই সাথে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধবংসস্তূপে পরিণত করেছিল এই সব গ্রাম। এলোপাথারী হত্যাযজ্ঞে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন প্রামানিকটারির ফজল ব্যাপারী, আবুল কাসেম, ছেরাবউদ্দিন, নুরবক্ত, সর্দারপাড়ার মন্তা, শিবরাম গ্রামের মন্তাজ আলী, আবদুল জলিল, জহুর আলী, খামারের অলিয়ার, মনদ্দি, আজিম , ফকিরপাড়ার নুহ খন্দকার, তালুক কালোয়ার বসন্ত কুমার, প্রতাপের হাছিমুদ্দিন, হরিকেশের রজব আলী, ঘোপাটারীর জহুর উদ্দিন, রায়পুরের ঘেচু মামুদ, সর্দার পাড়ার টেংরি বেওয়া, মাদ্রাসার ছাত্র শাহাদৎসহ ৩৫ জন।

সেই বিভৎসতার কথা মনে করে আজো আৎকে ওঠেন শহীদের স্বজনরা। শিবরাম গ্রামের মনোয়ারা জানান, দিনমজুরি করার সময় পাকবাহিনী তাঁর পিতা ময়েন উদ্দিন ব্যাপারী ও ভগ্নিপতি টলি মিয়াকে গুলি ও বেনয়েট চার্জ করে হত্যা করে। রায়পুরের জোবেদা বেগম চোখের সামনে তাঁর শ্বশুর ঘেচু মামুদ ও স্বামী জহুর উদ্দিনকে হত্যা করতে দেখেন। গুলি করে লাশ পুড়িয়ে দেয় নরপিশাচরা। এরপরেও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে হয়েছিল।
একই গ্রামের বৃদ্ধা হাজরা তার স্বামী ফজলে রহমান ব্যাপারীর মৃত্যু যন্ত্রণার কথা আজো ভুলতে পারেননা। শিবরাম গ্রামের জমিলা বেগম জানান, গরুর গাড়িতে যাবার সময় পাকবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে তার ভাই আব্দুল জলিল ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এই গাড়ির চালক ছিলেন জলিল। মা ও বোনদের চোখেন সামনেই তার করুণ মৃত্যু হয়।
পাকবাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে গ্রামবাসীদের অনেকেই পালাতে গিয়ে হত্যা কান্ডের শিকার হয়। মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে যাবার সময় শিবরাম গ্রামের আব্দুল হকের মা ও ভগ্নিপতি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এই ঘটনায় ৫ জন গুলিবিদ্ধ হন, মারা যান দুজন। আব্দুল হক জানান, তারা পালিয়ে সিংগীমারিতে যাবার সময় সামনে পাকবাহিনীর গুলির মুখে পড়েন।
শিবরামের সৈয়দ মোখলেছুর রহমান জানান, তাদেরকে নিরাপদে চলে যাবার ব্যবস্থা করে তার পিতা মন্তাজ আলী বাড়িতে থেকে যান। পাকবাহিনী বিনা কারণে তাকে হত্যা করে। তিনি জানান, ভানুরভিটা গ্রামের এক হিন্দু পরিবারের ধান জোর করে কাটার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এক রাজাকারকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতে স্থানীয় দালালরা পাকবাহিনীকে খবর দিয়ে নিয়ে আসে। সে সময় পিচ কমিটির সভাপতি ছিলেন সৈয়দ আজাদ বক্ত আলী। তার প্রধান সহযোগী ছিলেন তারই পুত্র সৈয়দ বক্ত আলী। বর্তমানে কুড়িগ্রামের উত্তরবঙ্গ জাদুঘরে এই দু’জনের ক্ষমা প্রার্থনার চিঠি প্রদর্শিত হচ্ছে। আর পাকবাহিনীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন কুড়িগ্রাম—২ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রত্যক্ষদর্শি অনেকেই এই দাবী করেছেন।
হত্যা ও অগিসংযোগ ছাড়াও নারী নিযার্তন করে পাক হানাদাররা। এক নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে মুখোমুখি লড়াই করে জীবন হারান চেরেঙ্গার দছিমনের স্বামী পনের উদ্দিন। শিবরাম গ্রামের আব্দুল্লাহ মিয়া জানান, তাঁর মা ও বোনদের যখন গুলি করা হয়, তখন এক নারীতে ধরে নিপীড়ন করে পাকবাহিনীর সদস্যরা। চেরেঙ্গার দছিমন জানান, ভাবির সম্ভ্রম রক্ষার্থে এক সঙ্গে দুই হানাদারের সঙ্গে বীরদর্পে তুমুল লড়াই করেন তার স্বামী পনের উদ্দিন। যদিও বেশীক্ষণ টিকতে পারেননি।
৫০ বছরেও দালাল রাজাকারদের বিচার না হওয়ায় হতাশ শহীদদের স্বজনরা। অনেকেই গুলির চিহ্ন শরীরে বহন করে বেড়াচ্ছেন আজোও। এদের মধ্যে রয়েছেন আব্দুল্লাহর বোন বানেছা ও শরিফা। তার মা আমেনাও গুলিবিদ্ধ হন। কয়েক বছর পরে মারা যান তিনি।
কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের প্রাক্তন ইউপি সদস্য আলতাফ হোসেনের বাবাকে মুক্তিযোদ্ধার ভাই—এই অভিযোগে কুড়িগ্রাম চানমারিতে নিয়ে গিয়ে গাছে ঝুলিয়ে নিযার্তন ও নিজের হাতে কবর খোঁড়ার পর গুলি করে সেখানে ফেলে দেয় পাকবাহিনী। তিনি নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার জন্য বিচার দাবী করেন।
স্থানীয় দিশারী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী শহীদদের কিছু নাম সংগ্রহ এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে ছোট একটি স্মৃতি সৌধ নির্মিত হলেও আজও সরকারি উদ্যোগে শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরী, দু:স্থ শহীদ পরিবারের পূণর্বাসন ও শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয়রা।
শুধু হত্যা নয় প্রায় চার শত ঘর বাড়ি পুড়িয়ে নারকীয় তান্ডব সৃষ্টি করে পাকবাহিনী। দেশ স্বাধীনের পর তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমান সরকার এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। নিমার্ণ করে দেয় অনেক কাঁচা ইটের ঘর—বাড়ি। কালের পরিক্রমায় এসব স্মৃতি চিহৃের অনেকগুলি নষ্ট হয়ে গেছে। টিকে আছে দু’একটি ঘর।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের খামার, প্রামাণিকটারি, সদার্রপাড়া, শিবরামসহ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ১২০টি পরিবারকে কাঁচা ইটের ঘর নিমার্ণ করে দেয়া হয়। এসব ঘরের দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট আর প্রস্থে ১১ ফুট।
খামার গ্রামের বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, পাকহানাদাররা তার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার পর তারা খোলা আকাশের নিচে বাস করেছেন। অনাহারে কেটে গেছে দিন। ঘর তোলার সামর্থ্য ছিলনা। এ সময় রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও আওয়ামীলীগ নেতা সৈয়দ ইসকান্দার আলীর সহায়তায় তালিকা তৈরী করা হয়। পরে তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী সৈয়দ মনছুর আলীর মাধ্যমে ১২০টি ঘর নিমার্ণের বরাদ্দ পাওয়া যায়। সিমেন্ট ও মাটি দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ইট তৈরী করে ঘর নিমার্ণ করে দেয়া হয়।
খামার গ্রামের আব্দুল হক ব্যাপারী ও আব্দুস সামাদ জানান, সংরক্ষণ ও মেরামতের অভাবে বেশীরভাগ ঘর নষ্ট হয়ে গেছে। তবে বেশ কয়েকটি এখনও টিকে আছে। যা কাঁঠালবাড়ী গণহত্যার ভয়াবহতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
স্থানীয় শিক্ষাবিদ সৈয়দ ইসতিয়াক আলী বলেন, ‘আর বিলম্ব না করে সরকারি উদ্যোগে দ্রুত স্মৃতিস্তম্ভ নিমার্ণ ও শহীদদের স্মৃতি রক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে একদিন এই বর্বরতার ইতিহাস পারিয়ে যাবে।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন কমান্ডের কমান্ডার আব্দুল আউয়াল গণহত্যার স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারিভাবে একটি স্মৃতিসৌধ নিমার্ণের দাবী জানান।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!