ভাঙনে বিপন্ন ৩ গ্রাম তিস্তার পারে নেই ঈদের আনন্দ

আব্দুল খালেক ফারুক:
তিস্তার পানি কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে। কিন্তু কমা—বাড়ার মাঝে থেমে নেই নদীর ভাঙন। রাজারহাট উপজেলায় গত এক মাসে তিস্তা গর্ভে চলে গেছে ৪ শতাধিক পরিবারের বসতভিটা। প্রায় ৫০ একর ঊর্বর আবাদী জমি, মসজিদ, ব্রিজ, কাঁচাপাকা সড়ক। ভাঙনে শিকার অনেক পরিবারের মাথা গোঁজার মতো জমি নেই। তাই কেউ চলে যাচ্ছেন চরে, অনেকেই চালাঘর ফেলে রাখছেন ফাঁকা জমিতে; আছেন অন্যের বাড়িতে। দু’মুঠো খাবার জোগার করতেই হিমশিম খাচ্ছে অসহায় পরিবারগুলো। ভিটেহারা মানুষের কান্না হাহাকারে ভারি হচ্ছে তিস্তার পার। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দ্বন্দ্বে অনেকের ভাগ্যে ভিজিএফের ১০ কেজি চালও জোটেনি। এ অবস্থায় ঈদের আনন্দ নেই তিস্তার পারে।
গতিয়াশাম গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কাদের বলেন, ‘বাড়িঘর, ভিটা সউগ ভাঙি গেইছে। নদীর পারোত পড়ি আছি। ঈদোত ছওয়াপোওয়া চাইরটা খামো, তারই উপায় নাই।’ চরে এমনিতেই কোরবানি কম হয়। এবার আবাদী জমি ও বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় কারো সামর্থ নেই কোরবানি দেয়ার। তাই এক টুকরা মাংস কারো পাতে পড়বে কীনা এ নিয়ে সন্দিহান তিস্তা পারের নদী ভাঙা পরিবারগুলো।
সরেজমিন দেখা গেছে, তিস্তা ব্রিজের পূর্বে লালমনিরহাট জেলার সীমানায় অবস্থিত চর নাখেন্দা থেকে গতিয়াশাম হয়ে খিতাবখা—বুড়িরহাট পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার জুড়ে নদীর পার ভাঙছে। ঘূুুর্ণিে¯্রাতের কারণে ভাঙন প্রলয়ঙ্করী হয়ে উঠেছে। গত এক মাসে এই এলাকায় ৪ পরিবার ভিটে হারিয়েছেন। গত এক বছরে সব মিলে ভিটেহারা পরিবারের সংখ্যা ৫ শতাধিক। গত এক মাসে ৬টি মসজিদ, ৬টি কাঁচা—পাকা রাস্তা, একটি ব্রিজ, ৩টি ইউড্রেন ও ৫০ একর জমি বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে খিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গতিয়াশাম বগুড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি স্কুল ও মসজিদ। প্রাথমিক স্কুল দুটি যে কোন সময় চলে যেতে পারে নদীগর্ভে। এইদুটি স্কুল রক্ষার্থে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হলেওও প্রবল ে¯্রাতে তা কার্যকর হচ্ছে কমই। বরং নদী দ্রুত গতি বদল করে বুড়িরহাট স্পারকেই ঝুঁকিতে ফেলছে। এই স্পারটি গত বছরের মতো ভাঙলে ভাটিতে ৫—৬টি গ্রাম পড়বে ভয়ঙ্কর ভাঙনের কবলে।
এদিকে ভাঙনের কবলে পড়ে অনেক পরিবার চলে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। এরমধ্যে তিস্তার ওপারে মাঝেরচরে যাচ্ছে বেশি। অনেকেই যাবার মতো জায়গা না পেয়ে ফাঁকা জমিতে বাঁশের খুঁুটির উপর ঝুলিয়ে রেখেছে ঘরের চাল। উপায় না পেয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রিত আছেন।
গতিয়াশামের সাইফুল ইসলাম নৌকায় ঘরের চালসহ মালামাল তুলে চলে যাচ্ছেন দ্বীপচরে (মাঝেরচর)। বলেন, ‘যাবার জাগা নাই। কোটে যাই। আপাতত দ্বীপ চরোত যামো। তারপর আল্লাহ যা করে করবে।’ ৮ লাখ টাকা দিয়ে আধাপাকা বাড়ি করেছেন শামসুল আলম। ১৫—১৬ জন মজুর—মিস্ত্রি লাগিয়ে দ্রুত বাড়ি ভেঙে ফেরছেন তিনি। আবাদী জমি সব বিলীন। এখন সামান্য এক টুকরো জমিতে খঁুছছেন মাথা গোজার ঠাঁই। গত বছ্র কোরবানি দিয়েছেন। এবার সঙ্গতি নেই। একই অবস্থা কৃষক নুরুল ইসলামসহ অনেকের।
নদীর পারে বাস করেন ফাতেমা বেগম। তিস্তা ভয়ঙ্কর গর্জনে রাত কাটে বিনিদ্র। চলে যাবেন—কিন্তু আর্থিক সংকটে যেতে পারছেন না। ফাতেমা বলেন, ‘ট্যাকা নাই পইসা নাই, কোটে যাই। হামার ফির ঈদ কীসের?’ আর্থিক সংকটের কারণে গতিয়াশামের নুরল ইসলাম, সোলায়মান আর সোহরাবের মতো অনেকেই কোথাও যেতে না পেরে নদীর পারেই ছাপড়া তুলে আছেন। এ অবস্থায় ঈদের কোন আমেজ নেই তিস্তা পারে। মঙ্গলবার ঘড়িয়ালডাঙা ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম জানান, দুনীর্তির অভিযোগে ৯ জন মেম্বার চেয়ারম্যান রবীনন্দ্রনাথ কর্মকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দাখিল করেছেন। সে কারণে চাল বিতরণ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। চেয়ারম্যান একাই চাল বিতরণ করছেন। কেউ পাচ্ছেন, কেউ ফিরে আসছেন চাল নিতে গিয়ে। এ অবস্থায় তিনটি গ্রামের কয়েকশ পরিবার চাল না পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারিভাবে নদীভাঙা পরিবারের পূণবার্সনে কার্যকর উদ্যোগে নেই। এ পর্যন্ত মাত্র ১০০টি পরিবার ২ হাজার করে টাকা ও শুকনো খাবার পেয়েছেন। এর বাইরে কিছু পরিবার ভিজিএফ’র চাল পেয়েছেন। কিন্তু এতে কাটছেনা তাদের থিতু হবার সংকট, ঘরে নেই ঈদের আমেজ।
রাজারহাট উপজেলা নিবার্হী অফিসার নূরে তাসনিম জানান, ভাঙনের শিকার ১০০ পরিবারকে নগদ অর্থ ও শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে। বাকীদের তালিকার প্রণয়ন করে সহায়তা করা হবে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী মো: আরিফুল ইসলাম জানান, তিস্তায় অন্যান্য বছরের তুলনায় ভাঙনের প্রকোপ বেশি। তবে ভাঙন প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। আশা করা যায় এতে ভাঙনে ক্ষতির পরিমাণ কমবে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!