কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে রোগীর ভিড়ে বেসামাল স্বাস্থ্যসেবা

আব্দুল খালেক ফারুক:
হাসপাতালের বারান্দা আর ওয়ার্ডের মেঝেতে শয্যা পেতেও স্থান সংকুলান হচ্ছেনা রোগীদের। আড়াইশ শয্যার হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকছে প্রায় ৪০০। আউটডোরে প্রতিদিন প্রায় দু’হাজার রোগীকে সেবা দিচ্ছেন মাত্র ৭—৮ জন চিকিৎসক। কড়িডোর—বারান্দা—ওয়ার্ড কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই রোগীর চাপে। চিকিৎসক, নার্সসহ জনবল সংকট আর রোগীর অতিরিক্ত চাপে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে এখন বেসামাল স্বাস্থ্যসেবা। কেউ কেউ ভিড়ের চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পাচ্ছেননা চিকিৎসকের দেখা। অনেকেই গরমে অতিষ্ট হয়ে চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন হাসপাতাল থেকে। এচিত্র প্রতিদিনরই।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল সুত্রে জানা গেছে, অনুমোদিত ৪২টি চিকিৎসকের মধ্যে শূন্য রয়েছে ২৫টি পদ। এরমধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন, গাইনী, অথোর্ সার্জারী,চক্ষুসহ গুরুত্বপূর্ণ ৬টি পদই শূন্য। এছাড়া ৫টি জুনিয়র কনসালটেন্ট এবং চক্ষু, সাজার্রী, গাইনীসহ মেডিকেল অফিসারের ১৪টি পদই শূন্য। রোগীর সেবা দেয়ার কাজে নিয়োজিত নার্সের ১৫২টি পদের মধ্যে ৪৪টি পদ শূন্য। মেডিকেল টেকনোলজিষ্টদের নবসৃষ্ট ২৪টি পদসহ তৃতীয় শ্রেণির ৫১টি পদের মধ্যে ৩৭টি পদই শূন্য। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণির ২৮৯টি পদের ১২৫টি পদ শূন্য থাকায় হাসপাতালের কার্যক্রম দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
হাসপাতাল সুত্র জানায়, ২৫০ শয্যার অন্তবিভাগে প্রতিদিন ৩৫০—৪০০ রোগী ভর্তি থাকার কারণে রোগীর খাদ্য ও পথ্য ভাগাভাগি করে দেয়া হয়। এতে কোন রোগীরই খাদ্য ও পথ্য চাহিদা মেটেনা। বহির্বিভাগে প্রতিদিন দেড় থেকে দুহাজার রোগীর সেবা দেন মাত্র ৭—৮ জন চিকিৎসক। কারণ ১৭ জন চিকিৎসকের অন্যরা জরুরি বিভাগ, কভিট ইউনিট, পোস্টমোর্টেম, অপারেশন থিয়েটারসহ একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে চিকিৎসকের কক্ষে ঠেলাঠেলি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে নিত্যদিন। অনেকেই ভিড়ের কারণে আরো অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যান বাড়িতে। প্রায় আড়াই হাজার রোগীর সঙ্গে আসা স্বজন মিলে প্রতিদিন ৫—৬ হাজার মানুষের ভিড়ে সরগরম থাকে হাসপাতাল চত্বর।
রবিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সরেজমিন এই হাসপাতালে অবস্থান করে দেখা গেছে রোগী আর তাদের স্বজনদের ভিড়ে বারান্দা, কড়িডোর, ওয়ার্ডে যেন হাট বসেছে। চিকিৎসকের কক্ষ ও ওষুধ বিতরণ কক্ষের সামনে দীর্ঘ লাইন। সদর উপজেলার পলাশবাড়ি থেকে আসা গৃহবধূ রোকেয়া বেগম জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতালে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। প্রায় তিনঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও চিকিৎসকের কক্ষের সামনে যেতে পারেননি। সামনে পেছনে রোগীর ঠেলাঠেলি আর ভিড়ে তার অবস্থা করুণ। ঘামে শরীর জেরবার। বলেন, ‘তিন ঘণ্টা দাড়ে থাকিয়াও ডাক্তারের দেখা পাইনাই। এলা গরমোতে টেখা যায় না। কোমবালাযে পড়ি যাই।’ বেলগাছার ধরঞ্জয় গ্রামের রিপন মিয়া জানান, আধা ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট নিয়ে, লাইনে চিকিৎসককে দেখাতেই দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। আবার ওষুধ নেয়ার কাউন্টারেও আধাঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, লকডাউন পরবর্তি সময়ে রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক। এর বিপরীতে চিকিৎসক ও নার্স নিয়মিত বদলী নিয়ে চলে যাওয়ায় শূন্য হচ্ছে পদ। একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, ‘সবাই বদলী নিয়ে চলে যাচ্ছে। এতো রোগীর সেবা দিতে আমাদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’
সরেজমিন আরো দেখা গেছে, অন্তবিভাগের প্রতিটি ওয়ার্ডে রোগীর চাপ। রোগীর ভিড় কক্ষ ছাড়িয়ে বরান্দা পর্যন্ত এসে গেছে। তাও মিলছেনা ঠাঁই। শিশু বিভাগের সামনে কথা হয় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের শিবরাম গ্রামের রাজু মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, তার ছেলেকে শনিবার রাতে ভর্তি করাতে এসে দেখেন শয্যা খালি নেই। মেঝেতেও জায়গা নেই। পরে বারান্দায় চাদর বিছিয়ে রাত কাটিয়েছেন।
এদিকে গত মে মাসে হস্তান্তর করা হাসপাতালের নতুন ভবনে করোনা ইউনিট চালু করা হয়েছে। এখন করোনার প্রকোপ কমলেও আবার বাড়ে কীনা এই শঙ্কায় কর্তৃপক্ষ করোনা ইউনিট বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এখানে শয্যা খালি থাকলেও পুরাতন ছোট ভবনে রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কতৃর্পক্ষ।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিংকন জানান, সীমিত জনবলের কারণে বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। তারপরেও স্বল্প জনবল নিয়ে সেŸার্চ্চ চেষ্টা করে রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। জনবলের জন্য চাহিদা দেয়া দেয়া হয়েছে। জনবল পেলে সংকট থাকবেনা বলে মনে করেন তিনি।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!