দৃশ্যপটগুলি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে

নুসরাত জাহান:  

মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর। মিলিটারি ক্যাম্প শব্দটি শুনলেই যেকোনো বাঙালি হৃদয়ে ভেসে ওঠে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দৃশ্যপট। আর গুপ্তচর শব্দটি গোয়েন্দা কাহিনী ইঙ্গিত করে, যা সাধারণত কিশোরদের উদ্দেশ্যেই লেখা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তব প্রেক্ষাপটে রচিত পাঁচটি গল্পের সমন্বয়ে প্রগতিশীল লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সংগঠক আব্দুল খালেক ফারুক রচিত কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর’। 

সাধারণত একটি বইয়ের প্রচ্ছদই পাঠক কে প্রথম আকর্ষণ করে। সেদিক থেকে লেখকের ইতোমধ্যে প্রকাশিত বইগুলোর প্রচ্ছদ নির্বাচনের তারিফ করতেই হয়। ‘মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর’ বইটিও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু গাছগাছালির নিচে মিলিটারি ক্যাম্প। চতুর্দিকে রয়েছে প্রহরী। আর এই ক্যাম্পের দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে একটি বালক। এমন দৃশ্যপটের উপরে ঝকঝকে লাল রঙে লেখা শিরোনাম মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর এবং নিচের লেখক এর নাম। বইটি হাতে নিলেই শিরোনাম আর প্রচ্ছদ মিলে মোটামুটি একটা ধারণা দেয় পাঠককে। 

সূচিপত্র পেরিয়ে পড়া শুরু করতেই দ্রুম দ্রুম! চমক সৃষ্টি করে পাঠক হৃদয়ে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন প্রতিনিয়ত এ শব্দ আত্মায় কম্পন সৃষ্টি করতো এদেশের মানুষের। অতিপরিচিত এই শব্দ দিয়েই শুরু হয় বইটির নামগল্প ‘মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর’। মোসলেম মিয়ার সাথে আট বছর বয়সী আলমের আলাপচারিতা মুহূর্তেই পাঠককে নিয়ে যায় তার শৈশবে। তারপর হঠাৎ মিলিটারির গুলির শব্দ কানে এলে মোসলেম চাচার কাঁধে চেপে নিরাপদ দুরত্বে যাবার প্রাণপন চেষ্টা থাকলেও শেষ রক্ষা হয়নি। গুলি আলমের গায়ে ঠিকই লেগেছে। সৌভাগ্যজনক ভাবে বেঁচেও গিয়েছে সে। ১৫দিনের কবিরাজি চিকিৎসায় সেরে ওঠার পর একদিন পাশের বাড়ির কাদের চাচার দুধ ও কলা বেচতে যাবার পথে আলমকে ডেকে নিয়ে যায় মিলেটারিরা। এ খবর বাড়িতে পৌছালে কান্নার রোল উঠলেও পরবর্তীতে আলমকে ফিরতে দেখে স্বস্তি পান বাড়ির লোকজন। এরপর বাবা-মায়ের কঠোর নিষেধ সত্ত্বেও ভাল খাবারের লোভে লুকিয়ে লুকিয়ে ক্যাম্পে যেত আলম। এরপর যুদ্ধ আরো তীব্র হয়। বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকতে হয় যা আলমের কাছে বিরক্তিকর লাগে। হঠাৎ একদিন মুক্তিফৌজেরা পরামর্শ করে আলমকে আবারও পাঠায় দুধকলা নিয়ে। আর সেদিনের আলমের নিয়ে আসা তথ্যানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বৃহৎ অপারেশন সফল হয়। জয়বাংলা ধ্বনি উচ্চারিত হতে হতেই পরবর্তী গল্প নিমক শপথ।

‘নিমক শপথ’ গল্পে তৎকালীন নবম-দশম পড়ুয়া এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ঠিক কিভাবে দেশমাতৃকার তরে তার শপথ রক্ষা করেছে সেই কাহিনীই উঠে এসেছে। দেশের জন্য যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল সে। একবার নিজ এলাকার খুব কাছাকাছি এলে মাকে একটিবার দেখবার আকুতি যেন জেঁকে বসে। সুযোগও হয়ে যায়। অনেকদিন পর মায়ের হাতের রান্না গিলছে গোগ্রাসে। এমন সময় পিস কমিটির সদস্য বাবাকে মিলিটারি নিয়ে আসতে দেখা যায়। ভাগ্যক্রমে পালিয়ে বাঁচলেও পরবর্তীতে নিজে হাতে দেশের শত্রু বাবার বুক বুলেটের আঘাতে ঝাজরা করে দেয়। রক্ষা করে দেশের তরে নেওয়া নিমক শপথ।     

বইটির তৃতীয় গল্প ‘দাদুর দেওয়া ঘড়ি’। প্রায় সব মানুষের কাছেই উপহার অনেক বেশি স্পেশাল হয়। আর প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া জিনিস তো অনেক স্মৃতিচিহ্ন বহন করে। কে চায় এই স্মৃতিচিহ্ন কাছ ছাড়া করতে! কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আজিজারও চায়নি। প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে সে, দাদু হজ্বে গিয়ে তার জন্য সুন্দর ঘড়িটি এনেছিল। এই ঘড়িটি সাথে করেই বাড়ীর পাশের ক্লাস নাইনে পড়া আহম্মদ সহ কাউকে কিছু না জানিয়েই যুদ্ধে পাড়ি জমিয়েছিল সে। আজিজার আর ফিরতে পারেনি। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সহযোদ্ধারা ঘড়িটি পৌছে দেয় মায়ের কাছে। পুত্রশোকে মায়ের পরিণতিতে পাঠক যখন দুঃখভারাক্রান্ত, পাতা ওল্টাতেই আরেক ক্ষুদে বীরের গল্প “ক্ষুদে কমান্ডার”।      

ক্ষুদে কমান্ডার গল্পের নায়ক কুড়িগ্রামের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আব্দুল হাই। বয়স এবং উচ্চতা দুটোই কম। রিক্রুটিংয়ের সময় যাকে কয়েকবার দূর দূর করে খেদিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই বেঁটে-খাটো মানুষটি ট্রেনিং এবং একেরপর এক তাক লাগানো সাফল্যে দায়িত্ব পান সেকশন কমান্ডারের। আক্রমণে আক্রমণে পর্যুদস্ত করে মিলেটারিদের বিতারিত করে কুড়িগ্রামে উত্তলন করেন বিজয় পতাকা। 

সর্বশেষ গল্প গাড়িয়াল। গরু বা মহিষের গাড়ী চালকে সাধারণ গাড়ীয়াল বলা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকবাহিনী কতৃক হত্যা, খুন, গুম ধর্ষণ সম্পর্কে মোটামুটি সবাই অবগত। প্রত্যেকেই চাইতো নিজের পরিবারের সবাইকে নিরাপদে রাখতে। গাড়ীয়াল আফজাল জলিলের পরিবারের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে গোলাগুলির শব্দ বৃদ্ধি পেলে আফজাল গাড়ী ঘোরাতে চায় কিন্তু বাধ সাধে জলিল। সে নিজেই চালকের আসনে বসে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে গাড়ি। হঠাৎ গুলি এসে লাগে তার গায়ে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে সে।       

বইটির প্রতিটি গল্পই যেমন ইতিহাস জানতে সাহায্য করে তেমনি পাঠককে নিয়ে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই সময়ে। পাতা ওল্টানোর সাথে সাথে দৃশ্যপটগুলি যেন একে একে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর এখানেই গল্পকারের সার্থকতা। কিশোর গল্পগ্রন্থ হলেও এটি শুধু কিশোরদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে সকল বয়সী পাঠকদের জন্য সুখপাঠ্য একটি গ্রন্থ।        

বই সমাচার-

বই: মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর (গল্পগ্রন্থ)

লেখক: আব্দুল খালেক ফারুক 

প্রকাশক: মো. আব্দুল কাদের

প্রকাশন: বাবুই

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২১

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: আল নোমান

পৃষ্ঠা: ৪৮

মূল্য: ১৫০৳

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!