হাজার নৌকার যাত্রাপুর ঘাট

আব্দুল খালেক ফারুক:
ব্রহ্মপুত্র নদের ঘাট যাত্রাপুর। শনি ও মঙ্গলবার—সপ্তাহের দু’দিন হাট বসে ভারত সীমান্তের কাছে অবস্থিত যাত্রাপুরে। হাটবারে পণ্য ও যাত্রী পারাপারে ভিড় বাড়ে ঘাটে। সারাদিনে প্রায় এক হাজার নৌকা যাতায়াত করে যাত্রাপুর ঘাটে। যাত্রী, মাঝি আর দোকানিদের হাকডাকে সরগরম থাকে কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ঘাট।
আকবর নাইয়ার ৫০
চর যাত্রাপুরের আকবর আলী ৫০ বছর ধরে টিকে আছেন নৌকার মাঝি হিসেবে। তিন পুরুষের পেশা। লোকে ডাকে আকবর নাইয়া। বাবার সঙ্গে ১৫ বয়সে নৌকার হাল ধরেছিলেন। এখন ছেলেও বইছে নৌকা। কাছে দুরের অনেক চরে যাত্রী ও পণ্য পারাপার করেন। ধার—দেনা আর এনজিওর ঋণে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে নৌকা বানিয়েছেন। সেই নৌকার আয়েই জীবন চলছে কায়ক্লেশে। ভারত সীমান্তের কাছের চর দৈ খাওয়ার বাসিন্দা আইয়ুব আলী মাঝি। ৪০ বছর ধরে নৌকা চালান। আগে ঢাকা, নারায়নগঞ্জসহ অনেক দূরে যেতেন। এখন ৪০ হাত নৌকায় যাত্রাপুর ঘাট থেকে চরে চরে যান যাত্রী ও পণ্য নিয়ে। তারমতো ২০ বছর ধরে নৌকা বইছেন চর যাত্রাপুরের আব্দুস সামাদ। চর থেকে যাত্রী আর পণ্য আনেন যাত্রাপুর ঘাটে। এই ঘাটের সঙ্গেই সখ্য বারোমাস। বলেন, ‘আগে মাছ ধরে খাইছি। ভাতের কষ্ট ছিল, এখন শ্যালো নৌকা কিনি ভালোই চলছি। আগে এতো নৌকা ছিলনা। এখন হাটের দিন এক হাজার নৌকা আসে। অন্যদিনে একশর বেশি নৌকা যাতায়াত করে।’
চর থেকে ঘাটে
যাত্রাপুর ঘাটে নানা সাইজের, নানা রঙের নৌকা আসে। মাছ ধরার ডিঙি নৌকা থেকে শুরু করে পণ্যবাহী বড় বড় মহাজনী নাও। এখান থেকে ভারতের আসাম সীমান্ত খুব কাছে। ব্রহ্মপুত্র ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে যে চরের পাশ দিয়ে, তার নাম অট্রআশির চর। দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। ওপারে আসামের ছালাপাড়া, তিনশ বিঘা, বুদাখার হাট। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এসব হাট থেকে লোকজন আসতো যাত্রাপুর হাটে মালামাল নিয়ে। এখন ভগবতির চর, ইটালুকান্দা, ফকিরের চর, দৈ খাওয়া, আইরমারী, সাহেবের আলগা, জাহাজের আলগা, ঝুনকার চর, কালির আলগা, রলাকাটা, নারায়ণপুর, বারোবিশ, অট্রআশি, চর কাঁপনা, নুনখাওয়া, শান্তিয়ার চর, নুনখাওয়া, মাদারগঞ্জ, কচাকাটা, শৌলমারীসহ ছোট বড় দুই শতাধিক চর থেকে মালামাল ও যাত্রী আনা নেয়ার কাজ করেন মাঝিরা। ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার তীরের এসব চর এলাকায় সড়ক যোগাযোগ নেই। বিশাল এলাকা জেগে আছে নদেও বুকে। চলাচলের একমাত্র ভরসা নৌকাই।
নৌকায় হরেক পণ্য
চরে উৎপাদিত ধান, পাট, কাউন, চিনা, বাদাম, ডাল, কলাসহ নানান কৃষিজ পণ্য নিয়ে চরের মানুষ আসে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাট যাত্রাপুরে। চর থেকে যাত্রাপুর হাটে গরু নিয়ে আসে অনেক নৌকা। চরে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত কাশ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যায় কিছু কিছু নৌকা। এছাড়া নিমার্ণ সামগ্রী, কৃষি উপকরণ, খড়সহ বিচিত্রি পণ্য পরিবহন হয় এই যাত্রাপুর ঘাট থেকে। বছরের বারোমাস তাই সরগরম থাকে যাত্রাপুর ঘাট আর হাট।
যাত্রা থেকে যাত্রাপুর!
যাত্রাপুরের নামকরণ নিয়ে রয়েছে দুইমত। স্থানীয় প্রবীণ হোমিও চিকিৎসক সাইফুর ও রহমান ও ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম জানান, ১৯৪৬ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্রে ভারত থেকে স্টিমার যাতায়াত করতো। মনমোজন করঞ্জাই, হরিচরণ করঞ্জাইসহ মারোয়ারি ব্যবসায়ীরা বেশ জেকে বসেছিল ঘাটে ব্যবসার পসরা নিয়ে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন আফসার ব্যাপারী ও খয়েন উদ্দিন। এই যাত্রাপুর ঘাটে আসাম থেকে চিলমারী বন্দরগামী স্টিমার থামতো। আবার যাত্রা করতো—একারণে যাত্রাপুর নামকরণ হতে পারে। উত্তরে চর কাপনায় বালুর নিচে চাপা পড়ে আছে একটি জাহাজ। সে ইতিহাসও জানে এলাকার প্রবীণরা। তবে নামকরণ নিয়ে এলাকার মানুষের রয়েছে ভিন্নমতও। প্রবীণদের অনেকেই মনে করেন, এই এলাকায় একাধিক যাত্রাদল ছিল। কুশান গান ও গাতার গানও ছিল দারুণ জনপ্রিয়। ধান নিড়ানির সময় সমস্বরে ধরা গাতার গান হাওয়ায় মিলিয়ে যেত দূর গ্রামে। আমুদে মানুষ এসব গান থেকে অশেষ বিনোদন পেতো। এই যাত্রাগান থেকে যাত্রাপুর নাম হতে পারে। যাত্রাপুর হাট অনেক বড় হাট। সব পণ্যের বিপুল সমাহার।
ঘাটের উত্থান—পতন
কুড়িগ্রাম শহর থেকে যাত্রাপুর ঘাটের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। বৃটিশ জমানায় চর যাত্রাপুর গ্রামের উত্তরে ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ। নদের পারেই ছিল যাত্রাপুর ঘাট। আর দক্ষিণে দুই কিলোমিটার দূরে কুড়িগ্রাম শহর হয়ে ট্রেন আসতো রেলবাজার স্টেশনে। এখন যা রেলবাজারের চর নামেই প্রসিদ্ধ। ঘাটের পাশেই ছিল বিশালাকারের বটগাছ। চৈত্রের দাবদাহে পথচারিরা ক্ষাণিকটা জিরিয়ে নিতো বটের ছায়ায়। সেই গাছের গোড়ায় বসতো গানের আসর আর যাত্রাগান। ব্রহ্মপুত্রের আগ্রাসী থাবার এখন এসব কেবলি স্মৃতি। এখন বষার্য় একেবারে হাটের কিনারে সরে আসে যাত্রাপুর ঘাট। শত শত নৌকা আসে ব্রহ্মপুত্রের বুকে ঢেউ খেলিয়ে। আর শুকনো মৌসুমের ছয়মাস আধাকিলোমিটার চর ভেঙে যেতে হয় ঘাটে। পথের ধূলোয় মাখামাখি হয়ে ক্রেতা—বিক্রেতার কাফেলা ছোটে ঘাটে—হাটে।
ঘাটে মেলার আবহ
মাইকে অনবরত বাজছে বাহের দেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরা ভাওয়াইয়া গান, নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন কানে আসে আকছার। হাটের কিছু দোকনদার ঘাটেই বসিয়েছেন পণ্যের পসরা। সার, কীটনাশক, চালসহ মুদি পণ্য। আর খোলা আকাশের নিচে মাদুর বিছিয়ে বসেছেন জিলাপি, গজা খোমরা নিয়ে ময়রারা। চানাচুর, আচার, বেলুন আর খেলনার দোকানও বসে সারি সারি। ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলার আবহ চারপাশে। এখানে আছে খাবারের হোটেল। সেখানে মেলে ব্রহ্মপুত্রের তাজা মাছের ঝোল। মুদি দোকানদার রেজাউল করিম জানান, হাট থেকে ঘাটে পণ্য আনতে অনেকের বাড়তি খরচ হয়। তাই ঘাটেই দিয়েছেন অস্থায়ী দোকান।
গরুরগাড়ি থেকে ঘোড়ার গাড়ি
এক সময় উত্তরের অন্যান্য এলাকার মতো ব্রহ্মপুত্র আর ধরলার তীরের গ্রামে গ্রামে ছিল গরু আর মহিষের গাড়ি। এই যাত্রাপুরেও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। এখানে মনছার গাড়িয়াল, মজনু গাড়িয়াল আর আবু তালেব গাড়িয়ালের মতো অনেকেই গরু—মহিষের গাড়িতে ব্রহ্মপুত্র থেকে ধরলার ঘাটে যাতায়াত করতেন। এখন পণ্য পরিবহন আরো সহজ করতে চালু হয়েছে ঘোড়ার গাড়ি। এলাকার মানুষের দেয়া তথ্য মতে যাত্রাপুর ও পাশের পাঁচগাছি, ঘোগাদহ ও ভোগডাঙা ইউনিয়নে প্রায় ৩০০ ঘোড়ার গাড়ি চলে। যাত্রাপুর ঘাটে দেখা হয়, শুলকুর বাজারের ঘোড়ার গাড়ি চালক ছদর উদ্দিনের সঙ্গে। জানান, ২৫ বছর গরুর গাড়ির গাড়োয়ান ছিলেন। এখন ঘোড়ার গাড়ি চালান ২০ বছর। খানাখন্দ আর ভাঙা সড়কে দিব্যি ছুঠে চলছে তার ঘোড়া। যাত্রাপুরের খান পাড়ার বাসিন্দা গোড়ার গাড়ি চালক জমসেদ আলী জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি ঘোড়ার গাড়ি চালান। এরমধ্যে ২৫টির মতো ঘোড়া মোটাতাজা করে বিক্রিও করেছেন। যাত্রী ও পণ্য আনা নেয়ার কাজ করেন ঘাটে। দৈনিক আয় ৩০০—৮০০ টাকা।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!