কুড়িগ্রামে টানা বৃষ্টিতে তিস্তার চরে কৃষকের কাঁধে ঋণের বোঝা

বিভাস প্রতিবেদক:
জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে টানা ভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ী ঢলে তিস্তার চর প্লাবিত হওয়ায় বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ, রসুন, বাদাম ও সবজির ক্ষতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তিস্তাপারের কৃষকরা। নদীর পানি যতই বাড়ছে কৃষকের কাঁধে ততই বাড়ছে ঋণের বোঝা। এ অবস্থায় হতাশায় দিন কাটানো কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে কৃষি বিভাগ। রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সুত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম দশ দিনে ২৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ১৫—১৬ এপ্রিল পর্যন্ত শিলাবৃষ্টিসহ মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টির পূবার্ভাস দিয়েছে স্থানীয় এই আবহাওয়া অফিস।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়াল ডাঙা ও বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তিস্তার চরে শত—শত কৃষক লক্ষ—লক্ষ টাকা ধার—দেনা করে পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা ধরণের সবজির আবাদ করেছেন। কিন্তু ভারি বৃষ্টির কারণে ডুবে গেছে এসব ফসলের ক্ষেত। চৈত্র মাসে অসময়ে টানা বৃষ্টির কারণে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে চরাঞ্চলের আবাদকৃত জমি পুরোটাই পানি নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। হাঁটু পানিতে নেমে পঁচা পেঁয়াজ,রসুন, বাদাম, ধান তুলেছেন অনেক কৃষক।
বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তৈয়ব খাঁ গ্রামের বাসিন্দা কৃষক হক্কানী ব্যাপারী জানান বলেন, ‘আমরা স্বপ্নেও জানি না চচৈত্র মাসে এমন বন্যা হবে। আমার ৬ একর জমিতে ছিল বাদাম,পেঁয়াজ,কুমড়া,কালজিরা,ধনিয়া চাষ করেছি। এবারের বন্যায় সব শেষ। এর আগে কার্তিক মাসে আলু চাষ করলেও বন্যার পানির জন্য পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে সার,কীটনাশক,ওষুধ,বীজসহ ইত্যাদি খরচে প্রায় ১১লাখ দেনা করেছি। এই ফসল তুলে সেগুলো শোধ করতাম। এখন কিভাবে এই দেনা শোধ করব চিন্তায় ঘুম আসে না।’
কৃষক কুদ্দুস মিয়া বলেন,আমি মাস্টার্স পাশ করে কোন চাকুরি খুঁজিনি। ইচ্ছে হলো কৃষক বাবা কৃষি কাজে সহযোগিতা করে আত্মনির্ভরশীল হবো। কিন্তু অকাল বৃষ্টির কারণে সেই স্বপ্ন ডুবে গেছে।
কৃষক ফখরুল ইসলাম বলেন,চরের মধ্যে পিয়াজ ৫একর এবং বোরো ধান ৪ একর জমিতে চাষ করেছি প্রায় ৭লাখ টাকা ঋণ করে। হঠাৎ এমন বন্যায় সব শেষ হয়ে গেল। তিস্তা নদীর চরের আবাদ দিয়ে দেশের শাক—সবজি, মসলার চাহিদা হয়।
কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন,‘প্রায় ৪লাখ টাকা ব্যয় করে সাড়ে একর জমিতে পিয়াজ আবাদ করেছি। ফলনও ভালো ছিল। বিঘা প্রতি ৮০/৮৫মণ পিয়াজ পাওয়া যেতো। হঠাৎ পানি আসায় ১৫/২০মণ পিয়াজ তুলতে পেরেছি। এখন সেই পেঁয়াজ ৫টাকা কেজিতেও মানুষ নেয় না। কামলা খরচে উঠছে না। দু’সপ্তাহ ধরে টানা বৃষ্টিতে নদীতে পটল, ঝিঙা, মরিচ, করলা, শসা, চিচিঙ্গা এবং শাক—সবজির ক্ষেতে তলিয়ে গেছে। এগুলোর পঁচানি গন্ধে তিস্তা পারে যাওয়া যায় না।’
ফসলহানী হওয়ায় মারাত্নক আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন কৃষক পরিবারগুলো। এই রোজায় সন্তান,পরিবার নিয়ে সংসার চালানোই দায়। তার উপর পাওনাদারের চাপে বিপাকে তিস্তা পারের কৃষক। ঋণ করে সার,কীটনাশক,ওষুধ, বীজসহ সব মিলিয়ে লক্ষ—লক্ষ টাকা খরচ করেছেন এখান কৃষক। কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন,তা ভেবেই নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।
কৃষাণী মোকছেনা বেগম বলেন, ‘এই যে ওজা (রোজা)র মধ্যে ছোয়া—পোয়া নিয়া সংসার কিভাবে চলবে? ওজার মধ্যে খাওয়ার সেই কষ্ট হয়া গেইছে। মানুষে তো আর ইন(ঋণ)—পাওনা ছাড়ব্যান নয়। মানুষক তো ইন—পাওনা শোধ করায় নাগবে।’
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ—পরিচালক আব্দুর রশীদ জানান, জেলার ৪টি উপজেলায় ২৭৩ হেক্টর বোরো ধান,পেঁয়াজ,তরমুজ,পাট,ভুট্টা,চিনাবাদাম,শাক—সবজি আক্রান্ত হয়েছে। বৃষ্টিপাত বেশি হলে ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়বে। ইতোমধ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের তালিকা প্রস্তুত শুরু করা হয়েছে।’ আউশ মৌসুমে সরকারের প্রণোদনা রয়েছে। সেই তালিকা ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের অন্তভুর্ক্ত করা হবে এবং কৃষক তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!