বহুমাত্রিক লেখক আব্দুল খালেক ফারুক -এর গল্পগ্রন্থ ‘লেখকের বিড়ম্বনা’

নুসরাত জাহান:
বিড়ম্বনা অতিপরিচিত একটি শব্দ। আমাদের প্রাত্যাহিক চলার পথে নানাবিধ মানুষকে হরেকরকম বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা হতদরিদ্র -কেউই এর বাইরে নয়। খ্যাতির বিড়ম্বনা কেমন হয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে দেখিয়েছেন। আর এসময়কার বহুমাত্রিক লেখক আব্দুল খালেক ফারুক তার গল্পগ্রন্থে নেতার বিড়ম্বনা দেখানোর পর এবারে নিয়ে এসেছেন ‘লেখকের বিড়ম্বনা’। বাস্তবতার ব্যঙ্গাত্বক উপস্থাপন অর্থাৎ রম্যগল্পে সিদ্ধহস্ত আব্দুল খালেক ফারুক।  তার ইতোমধ্যে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো তাই ধারণা দেয়। এই গল্পগ্রন্থটিও তার ব্যতিক্রম নয়। বইটি হাতে নিলেই চোখে পড়ে একজন বাজার-সদাইয়ের ব্যাগ নিয়ে দৌড়াচ্ছে অর্থাৎ পালিয়ে যাবার যোগার। পেছনে হতভম্ব চোখে চেয়ে আছে মাছ ব্যবসায়ী। প্রচ্ছদের এই চিত্রের সাথে বইয়ের নাম ‘লেখকের বিড়ম্বনা’ -এর পুরোপুরি মিল পাওয়া না গেলেও কেউ না কেউ যে বিড়ম্বনার দৌড়ানিতে আছে সেটা নিশ্চিত অনুধাবন করা যায়। এরপর বইটিতে স্থান পাওয়া নয়টি গল্প একে একে এর যথার্থতা নিশ্চিত করে।
গল্পগুলোর অধিকাংশই ২০২২ এবং ২০২৩ সালে লেখা। সর্বশেষ দুটি গল্পের একটি ২০০৩ এবং অপরটি ১৯৯৩ সালে রচিত। লেখকের গল্প গুলো হাসির ছলে হলেও রচনাকাল অর্থাৎ সেই সময়কে উপস্থাপন করে। সূচীপত্র উল্টে বইটির প্রথমেই রয়েছে নাম গল্প ‘লেখকের বিড়ম্বনা’। কবি জয়নাল জ্যাকসনের কবি  জীবনে সাংসারিক উটকো ঝামেলা এবং লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে বিপর্যস্ত জীবন। অবশেষে দুটি লাইন মগজে ঠোক্কর খেয়ে গল্পের ইতি ঘটে,”চারদিকে অনেক মৎস জালে ঢোকে নাকবিরাও হয় অসহায় পাঠক জানে না।”দ্বিতীয় গল্প ‘ভেড়াথেরাপি’। মানুষ যেমন মানুষের বন্ধু হয়, বিপদে সাহায্য করে। ঠিক তেমনি মানুষ জীবনে ভয়াবহ পরিস্থিতির স্বীকার হয় একই সমাজের কিছু বিপথগামী মানুষের কারনেই। মানুষ মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও পোষা এবং বিশ্বস্ত প্রাণিটি কখনো তা করে না। বরং এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শাহ আলমের ভেড়ার পালও তাই করেছে৷ ক্ষমতার অপব্যবহবহারকারীদের এ যেন এক যথোচিত জবাব। 
‘পাকাচুল’ আর ‘ডাবল পান’ গল্পে এই দুই শ্রেণীর মানুষের ভোগান্তি অর্থাৎ বিড়ম্বনার কথা বর্ণিত হয়েছে। পাকাচুলে অল্প বয়সী মানুষকেও বুড়ো লাগে। আবার কলোপ দিতে গেলে এলার্জির ঘায়েলে কাহিল হয়ে গল্পের নায়ককে বঞ্চিত হতে হয় শ্যালিকার বিবাহের আয়োজন থেকে। উত্তরবঙ্গের কিছু মানুষ আছে যাদের একবেলা ভাত না হলেও চলে। কিন্তু সবসময় মুখভর্তি পান-সুপারি চাই। এর ফলে নানাবিধ ভোগান্তির কথা উঠে এসেছে ‘ডাবল পান’ গল্পে। আর ‘মন্ত্রী ঘুমায়’ গল্পে লেখক ব্যাঙ্গাত্বক কৌশলে চপেটাঘাত করেছেন ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারক গোষ্ঠীকে। গল্পটির শেষ লাইন, “দেশের মানুষ যত কষ্টেই থাকুক, মন্ত্রীদের যেন ঘুমে ব্যাঘাত না হয় -এই প্রার্থনা সবার করা উচিত।”
‘জার’ গল্পে শীতকালে রাস্তারপাশে কিছু মানুষের আগুন পোহানো এবং এলাকার মেম্বারের সাথে কথোপকথনে উঠে এসেছে আরেক সমাজ বাস্তবতা। লেখকের কলমে, গল্পের মেম্বার চরিত্রের ভাষ্যে, “এইযে সরকার এতো কিছু সাহায্য করে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, উপবৃত্তি, ভিজিডি, ভিজিএফ, প্রতিবন্ধীভাতা—আরো কত ভাতা দেয়—আচ্ছা সত্যি করি কনতো আগামী ভোটোত তোমরা সরকারি দলোক ভোট দিবেন?না। দিবার নই। সরকার আলেম ওলামাক ধরি জেলোত থুচে। ভোট দেই কেমন করি। হামরা মোছলমানের বেটা না?’—মহির উদ্দিন তড়িৎ জবাব দেয়।‘জিনিষপত্রের দাম বাড়ে দিছে। কাজ কাম নাই। কিস্তি দিবার পাইনা। ভোট দেই কেমন করি।’—ময়জুদ্দি সোজা সাপটা কথা বলে। আর দুদু মিয়া আওয়াজ ছাড়ে—সরকার কী তার বাপের টাকা দেয়? হামার জনগনের টাকা হামাক দেয়। ক্যাশ ছাড়া হামরা ভোট দিবার নই। সোজা কতা শুনি নেও।’এবার মেম্বার আবু তাহের চিন্তিত হয়ে পড়েন। সরকারের এতো উন্নয়ন কী মাঠে মারা যাবে? পাবলিক এতো বিমুখ কেন?  চিন্তিত মেম্বারের শরীরে এবার জাড় লাগে। কাঁপুনি ধরে। মেম্বার আরো কিছু শুকনা পাতা ভিড়ার উপর তুলে দিয়ে একটা কাঠি দিয়ে আগুনটা উস্কে দেন।” 
আমাদের সমাজে বিবাহের এক অন্যতম অনুষঙ্গের নাম ঘটক। বিবাহের ক্ষেত্রে মানুষকে হরেকরকম কথার ফাঁদে আঁটতে সিদ্ধহস্ত তারা। ধান্দাবাজি করে বিবাহ দিতে গিয়ে মোটা অংকের ফি হজম করতে তাদের পোহাতে হয় নানান বিড়ম্বনা। আর এই কথার ছলাকলায় পাত্র-পাত্রী উভয়পক্ষকেও কম ভোগান্তির স্বীকার হতে হয় না। এমনি এক ঘটনা উঠে এসেছে ‘হারাগাছের হারাধন’ গল্পে। ‘এক মহিষ জবেহ হইবে’ -গল্পের মূল চরিত্র ছবরুল কসাই বিক্রির জন্য আনা মহিষটি অবশেষে আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া বড় বিবির চল্লিশা করে লোকজন খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।  বইটির সর্বশেষ গল্প ‘নয়াধান্দা’ গল্পে যেন ধান্দাবাজির শেষ নাই। হরেকরকম ধান্দাবাজি আর প্রাত্যাহিক জীবনে নানা বিড়ম্বনার বাস্তব চিত্রই রঙ্গ-ব্যাঙ্গ্যের ছলে উপস্থাপিত হয়েছে বইটির প্রতিটি গল্পে।
উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের লেখক আব্দুল খালেক ফারুক। পেশাগত জীবনে যিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত আছেন। সংবাদ সংগ্রহের তাগিদে প্রতিনিয়ত তাকে ছুটে চলতে হয় শহর-বন্দর, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, হাট বাজারে, চায়ের দোকানে, গ্রামগঞ্জ কিংবা ধূধূ বালুচরে। খুব কাছ থেকে অবলোকন করার সুযোগ ঘটে সময়ের ব্যবধানে নানা মানুষের বিচিত্রসব জীবন যাপনের। আর এ থেকেই নির্যাস তুলে এনে সমৃদ্ধ করেন লেখনীর ভান্ডার। বিভিন্ন সময় এরকমই রঙ্গ-ব্যাঙ্গের ছলে হাস্যরসাত্বক ভাবে চিত্রিত বাস্তবতার নিরিখে রচিত ৯টি গল্পের সমাহার ‘লেখকের বিড়ম্বনা’।গল্পগ্রন্থটির গল্পগুলোর বিড়ম্বনার কথা পড়ে চিন্তা-ভাবনা সমেত নিজেই যেন বিড়ম্বিত চিত্তে বসে আছি।

বই: লেখকের বিড়ম্বনা লেখক: আব্দুল খালেক ফারুক প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি- ২০২৩প্রকাশক: এনামুল হক (চমন প্রকাশ)প্রচ্ছদ: আলমগির জুয়েলমুদ্রিত মূল্য: ১৮০টাকা মাত্রপৃষ্ঠা:৪৭ পৃষ্ঠা 

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!