আব্দুল খালেক ফারুকের নেতার বিড়ম্বনা: রম্যছলে সময়ের ব্যাঙ্গাত্বক উপস্থাপন —নুসরাত জাহান

উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের লেখক আব্দুল খালেক ফারুক —এর গল্পগ্রন্থ ‘নেতার বিড়ম্বনা’। পেশাগত জীবনে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত আছেন। সংবাদ সংগ্রহের তাগিদে প্রতিনিয়ত তাকে ছুটে চলতে হয় শহর—বন্দর, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, হাট বাজারে, চায়ের দোকানে, গ্রামগঞ্জ কিংবা ধূধূ বালুচরে। খুব কাছ থেকে অবলোকন করার সুযোগ ঘটে সময়ের ব্যবধানে নানা মানুষের বিচিত্রসব জীবনযাপনের। আর এ থেকেই নির্যাস তুলে এনে সমৃদ্ধ করেন লেখনির ভান্ডার। বিভিন্ন সময় এরকমই রঙ্গ—ব্যাঙ্গের ছলে হাস্যরসাত্বক ভাবে চিত্রিত বাস্তবতার নিরিখে রচিত ১৬টি গল্পের সমাহার ‘নেতার বিড়ম্বনা’।

কথায় আছে, “আগে তো দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারী”। ব্যক্তিগতভাবে এই মন্তব্যের সাথে একমত না হলেও কেউ কেউ যে বইয়ের প্রচ্ছদ দেখেই আকৃষ্ট হন কিংবা বই সম্পর্কে ধারণা নেন —এটা প্রায়শই লক্ষ্য করি। সেদিক থেকে বিগত বইগুলোর মতো লেখকের এই বইটির প্রচ্ছদ নির্বাচনও প্রশংসার দাবী রাখে। বইয়ের নামের সাথে প্রচ্ছদের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। গল্পগুলো পড়বার সময় রচনাকালে বিশেষ দৃষ্টিপাত করেছিলাম। এই জেলার একজন বাসিন্দা হিসেবে গল্পগুলো যে সেসময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার ব্যঙ্গাত্বক উপস্থাপন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুরুতেই বইটির নাম গল্প, নেতার বিড়ম্বনা। যেখানে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের সুবিধাবাদী মানুষের কথা উপস্থাপন করেছেন। দেখিয়েছেন নেতা হবার বিড়ম্বনা। লেখকের ভাষ্যে,
“শীতের সময় ঘরে ঘরে ওয়াজের একটা প্রবণতা গত কয়েক বছরে বেশ জেঁকে বসেছে। তার উপর উচ্চস্বরে ‘ডিজে গান’ বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চলছে পিকনিকের মহোৎসব। চল্লিশা, মেয়ের বিয়ে, অসুখ বিসুখের চিকিৎসার জন্য হাতপাতা তো নিত্যকার বিষয়! শুধু কি তাই? হা—ডু—ডু, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ঘোড়দৌড়, নৌকা বাইচ— কোনটা কি বাকি আছে? মনে হয় করোনার কল্যাণে আবারও জেগেছে বাংলা। তা বাংলা জাগুক, তার তো ক্ষতি নেই। কিন্তু সব কারবারে তাকে চাঁদা দিতে হবে কেন? সবাই তার বাসায় চাঁদার জন্য এভাবে হামলে পড়বে কেন? পাঁচশ থেকে ইদানিং দুশতে নেমেও স্বস্তি নেই। খুচরা না থাকলে ডাইনে বায়ে থাকা কারো কাছ থেকে দুশ—তিনশ নিয়ে চান্দা পার্টিকে বিদায় করেন। নেতার অনুগামী হওয়াও বিপদ।”
এরকম অবস্থা চলতে চলতে একসময় মহাব্বত আলীকে অতিষ্ঠ হয়ে গাছে উঠে লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়, যা সময়েরই প্রতিবিম্ব।
এর পরের গল্প ‘লকডাউনে বাঁশডাউন’। যেখানে যেখানে করোনা মহামারী চলাকালীন লকডাউন কার্যকরে স্থানীয়দের বাঁশ বেঁধে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া এবং এতেকরে মানুষের ভোগান্তি তুলে ধরা হয়েছে৷ সেসময় এমন ঘটনা প্রায় সারাদেশেই ঘটেছিল। একই সাথে উঠে এসেছে অনলাইনে ক্লাস চালু করায় রিক্সাচালক বাবার কাছে মেয়ের মোবাইলের আবদার, বাল্যবিবাহের কথায় মেয়ের ৯৯৯ কল দেবার হুমকি! ভেকসিন নিয়ে ছড়ানো গুজবে আজিজুলের ভাবনায় লেখক উপস্থাপন করেন, “আজিজুল ভাবে, বেলুনের মতো কম বুদ্ধির মানুষের আর দোষ কি? দুষ্টু বুদ্ধির অনেকেই তো লকডাউনকে আলেম ওলামা নিধনের কৌশল আর ভ্যাকসিনকে মানুষ মারার ওষুধ মনে করে কত অপপ্রচার চালায়।” উক্ত দুটি গল্পের রচনাকাল ২০২১ সাল।
বইটিতে স্থান পাওয়া ২০২২খ্রীষ্টাব্দে রচিত দুটি গল্পের একটি ‘ভোটের বাজার’ যেমন সেসময়কার ইউপি নির্বাচনের বাস্তব হালচাল । তেমন অন্যটি ‘হাবলু ভাইয়ের স্বর্ণপদক’ যেন পদক কিংবা যশ—খ্যাতি লাভে মরিয়া মানুষের কাহিনি। ২০১৮সালে রচিত চারটি গল্পের তিনটির মূল উপজীব্য বিগত হয়ে যাওয়া তৎকালীন জাতীয় নির্বাচন। চমকপ্রদ নাম গুলোও সে ইঙ্গিতই দেয়। যেমন, ‘হায় মনোনয়ন! হায় মার্কা!’, মবিলম্যান ও নমিনেশন বাণিজ্য’ কিংবা ‘ত্যাঁদড় ক্যান্ডিডেট’। আর ‘ফেইসবুক চুলকানি’ গল্পটিতে একজন নেতার স্লিপ অব টাং এবং তৎক্ষনাৎ সেটি সংশোধন করে নেওয়া, সাথে ক্ষমা চাওয়া স্বত্তেও এ নিয়ে ফেইসবুকে বিভ্রান্তি ছড়ানো সুবিধাবাদী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলকারী ব্যক্তিদের ব্যঙ্গাত্বক উপস্থাপন। বিষয়টি ছিলো ভুলকরে নেত্রীর কাছে নৌকার বদলে লাঙ্গল চাওয়া। ঘটনাটি যে এই বইটি যাকে উৎসর্গ করা হয়েছে, লেখকের সেই প্রিয় বন্ধু কুড়িগ্রাম জেলার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাশেদুজ্জামান বাবু মহোদয় সম্পর্কিত এবং লেখক গল্পে গল্পে অপপ্রচার চালানো সেই ফেইসবুক চুলকানিবাজদের আচ্ছা ধোলাই দিয়েছে তা যেকোনো পাঠকেরই অতি সহজেই বোধগম্য।
২০১৭সালে রচিত হয় ‘স্লিপ এবং রিলিফ’ নামের গল্পটি। উঠে এসেছে আবুল মিয়ার মত সুযোগ সন্ধানী মানুষের দ্বারা সামান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্লিপ আর রিলিফের নেশাগ্রস্ততা, বহুবিবাহ এবং এনজিওর কিস্তি জটিলতা। আর এমপি সাহেবের স্লিপে একপোয়া মুড়ি আর একপোয়া গুড়, দায় সারা সাহায্য এবং সাহায্যের নামে ফটোসেশান এসব কিছুই যেন সময়ের প্রতিবিম্ব। ২০০৬ সালে রচিত ‘পাগল’ গল্পটি লেখকের শৈশব—কৈশরের স্মৃতিচারণ। সিজন পাগলের কান্ড কারখানা এবং মানুষের বৈচিত্র্য ভাবনার রূপায়ণ ঘটেছে এখানে।২০০৫সালে রচিত ৫টি গল্প স্থান পেয়েছে বইটিতে। গ্যাঞ্জাম আলীর বারো ধান্দা, ভাষণজীবী, নয়া হেকিম, আক্কেল আলী শয়তান দর্শন এবং মশক সমাচার। নয়া হেকিম গল্পটিতে কুদরতি দাওয়াখানার সর্বরোগের চিকিৎসার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। লেখকের ভাষ্যে, “এছাড়া হোমিওপ্যাথিক কিছু ফর্মুলা তিনি চালান করেন হোমিও ভক্ত রোগীদের উপর। ফকিরালির বিদ্যা জাহির করেন বাটি চালান দিয়ে। এর বাইরে এলোপ্যাথিক ট্রিটমেন্টও দেন মাঝেমধ্যে। জীবন ফার্মেসিতে কিছুদিন কম্পাউন্ডার থাকার সময় এই বিদ্যাও কিছুটা রপ্ত করেছেন। আর হারবাল পদ্ধতিও আধুনিক কবিরাজি পদ্ধতির লেটেস্ট সংস্করণ। অর্থাৎ কোনভাবেই তার হাত থেকে রোগী ফস্কে যাবার উপায় নেই।”
আক্কেল আলী শয়তান দর্শন’ —গল্পে সচ্ছতার আড়ালে প্রতিটি সেক্টরে চলমান দুর্নিতির সচিত্র উঠে এসেছে। জেলা ফুড অফিস, ট্রেজারি অফিস, জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সদর হাসপাতাল কিছুই বাদ যায়নি৷ হাসপাতালে নিজের চেম্বারের নেমপ্লেটে ধুলোর প্রলেপ জমা সর্বরোগ বিশেষজ্ঞ বসুবাবুর বিনা পুঁজিতে ক্লিনিক ব্যবসা এবং সিজার করতে গিয়ে রোগীর নাড়ি কেটে ফেলার গল্পটি সেসময় রচিত হলেও ঘটনা পরম্পরায় আজও চলমান। লেখক বলেছেন, “লোকে আড়ালে তার নাম দিয়েছে ‘নরপশু’। বসু বাবু ওসব গায়ে মাখলে তো?”
‘মশক সমাচার’ গল্পে সিটি করপোরেশনের দায়সারা কর্মকান্ডের কথা উঠে এসেছে। আর বইটির সর্বশেষ ২০০১সালে রচিত ‘ছ্যাঁকা খেয়ে একা’ গল্পে হাস্যরসাত্বক ভাবে লেখক কতিপয় ছ্যাঁকা খাওয়া প্রেমিক প্রবরের সত্য কাহিনি পেশ করেছেন। সব মিলিয়ে বইটির প্রতিটি গল্পই রম্যছলে সময়ের ব্যঙ্গাত্বক উপস্থাপন। যার উপজীব্য দেশ, কাল ও বিচিত্র মানুষ।

বই: নেতার বিড়ম্বনা
লেখক: আব্দুল খালেক ফারুক
প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২
প্রকাশক: এনামুল হক (চমন প্রকাশ)
প্রচ্ছদ: আশরাফুল আলম
মুদ্রিত মূল্য : ১৯০৳
পৃষ্ঠা: ৬৪

আলোচনায়:
নুসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ
অনার্স চতুর্থ বর্ষ (ইংরেজি বিভাগ)
রাজারহাট, কুড়িগ্রাম
মেইল: হঁংৎধঃ৯৮৭৫লধযধহ@মসধরষ.পড়স

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!