স্লি প এবং রিলিফ

আবুল মিয়া একজন সুযোগ সন্ধানী মানুষ। সুযোগের অপেক্ষায় সব সময় মুখিয়ে থাকেন। তার এই স্বভাব সম্পর্কে গ্রামবাসীরা ওয়াকেবহাল। তার বেশী পরিচিতি ‘ছাগল আবুল’ নামে। কারণ ছাগলের বালখিল্যতার সাথে তার দারুণ সখ্যতা। কথা শুরু করলে নন ষ্টপ ভজনা। ম্যা ম্যা ডাকতেই থাকেন।
তো গ্রামের সবার কাছে অতি চতুর হিসেবে পরিচিত আবুল মিয়ার নতুন প্রজেক্ট স্লি প, এই স্লি প এর সাথে সংসারের সওদার যোগ আছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, হাড়ি, বদনা-কী নেই? সাথে ক্যাশও থাকে। তাই একখানা স্লি প পেলে আবুলের খুশির সীমা থাকেনা। সেই হিসেবে বন্যা অনেকের ঘর-বাড়ি কেড়ে নিয়ে উদ্বাস্তু বানালেও আবুল মিয়ার হয়েছে পোয়াবারো। বাড়ির আঙিনায় সামান্য পানি উঠেছিল। ঘরে ঢোকার সাহস হয়তো পায়নি। সেই ঘরের একটি বাঁশের খুঁটি ছিল নড়বড়ে। তাই কিঞ্চিৎ কাত হয়ে পড়েছে টিনের ঘরটি। কৌশলগত কারণে ত্রিপল নিয়ে বাঁধের রাস্তায় আস্তানা গাড়েন আবুল। ছেঁড়া ফাটা পলিথিনের বেড়া দেন। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সর্বহারার খাতায় নাম লিখিয়ে নেমে পড়েন স্লি প মিশনে। পয়লা দিনেই স্থানীয় চেয়ারম্যান চিড়া-মুড়ি দেন। রাতে খিচুরি। আপদকালে এই খাবার মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা হলো-নিম্নচাপ সামাল দেয়া কঠিন হলো। চারপাশে শুধু পানি। বাড়ির টয়লেট ডুবে আছে, কাৎ হয়ে আছে। মহা বিপদ! বেকায়দা দেখে আবুল মিয়া খানাপিনায় খানিকটা রাশ টানলেন। ভাবলেন, আপাতত পাখির আহারের মতো সামান্য হলেই যথেষ্ট। দ্বিতীয় দিনে পেলেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের কাছে ১০ কেজি চালের স্লি প। আর্মি নেমে গেছে। তাই মাপজোক ঠিক ছিল। একবার রিলিপ বিতরণে ঘাপলা করায় এই মেম্বারকে পঁচা পানিতে গলা পর্যন্ত দুই ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন আর্মি সদস্যরা। সেই থেকে হুসিয়ার তিনি। জলপাই রঙ দেখেই জবান বন্ধ হবার জোগার।
মেম্বারের চাল হজম হবার আগেই স্লিপের সন্ধানে ঘোরাঘুরি শুরু করলেন আবুল। সমস্যা হলো কিস্তি বাবুদের উৎপাত থামছেনা। গ্রামীণ ব্যাংক, আশা ও ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়েছেন। সপ্তাহে তিনদিন কিস্তি গুণতে হয়। হিসেব ঠিক রাখতে পারেন না বলে বুক পকেটে একটি নোট বুক রাখেন। মুলত সেকেন্ডহ্যান্ড কাপড়ের ব্যবসা তার। পুঁজি কম থাকায় ব্যবসার প্রসার হয়নি। তো এই কিস্তির সাথে আবার আবার পাল্লা দিয়ে তার সংসারে এসেছেন বিবিরা। সর্বসাকুল্যে তার চার বিবি। বিবিদের নামে ঋণ তোলেন। সুদে আসলে ঋণের অংশ স্ফীত হলে নানা ছুতোয় বিবিকে তালাক দেন। এরপর নতুন বিবি। তারপরেও কিস্তি মাফ পাওয়া মুশকিল। ভয়াবহ বানের তান্ডবও ওদের দমিয়ে রাখতে পারছেনা। এখন কিস্তি বাবুদের কৌশলে এগিয়ে স্লি প মিশন চালিয়ে যাচ্ছেন। কারো কারো স্লি প পেয়ে ভাল দাও মেরেছেন আবুল। আবার কারো স্লিপে ব্যাজার হয়েছে মন। বাঁধের উপর থাকতে পেলেন এমপির স্লি প ভাবলেন, এমপি ঢাকায় থাকেন। এলাকায় তার দেখা পাওয়া আর আসমানের চাঁদ হাতে পাওয়া সমান। না জানি তার স্লিপের বরকত কত হয়! শেষ পর্যন্ত পেলেন এক পোয়া মুড়ি আর একপোয়া গুড়! তার দলের লোকরাই শরমিন্দা এ নিয়ে। ফেসবুকে নাকি এই মুড়ি-গুড় হাতে এক বৃদ্ধের উপহাসের হাসির ছবি দিয়েছে কোন দুষ্ট ছেলে। নানান জনে নানান কথা শোনেন আবুল। যারা রিলিপ দিতে আসেন। তাদের কারো আবার ফটোসেশনের ঝোঁক বেশী। তা হোক স্লি প মিললে হলো।
কিন্তু স্লি প শিকারী আবুলও বেকুব বনে গেলেন লোভের ফাঁদে পড়ে। একজন অপরিচিত লোক দেখে তার কোন ত্রাণদাতা সংস্থার লোক ভেসে পাকড়াও করতে চাইলেন। কিন্তু বিধি বাম। এ দেখি গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি বাবু। অগত্যা পিঠটান দিতে চাইলেও বাগড়া দিলেন বাবু। বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে কিস্তি দিচ্ছেননা। এবার গুণুনতো কিস্তির ৫০০ টাকা। অনেক অনুনয় বিনুনয় করে এ যাত্রা রক্ষা পেলেন আবুল। সেই থেকে হুসিয়ার। এখন স্লি প শিকারে অনেক কৌশলী হতে হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দল বেঁধে ঢুকে পড়ায় আবারো বিপত্তি। এবার আর ত্রাণ আসছেনা। তাই আবু মিয়া স্লি প মিশন থেকে ইস্তেফা দিতে হয়েছে। ভাবছেন রোহিঙ্গা সেজে ক্যাম্পে ঠাঁই নিবেন এবার।
-২০১৭

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!