বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় কালের স্বাক্ষী বোর্ডঘর

বিভাস প্রতিবেদক:
কালের স্বাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকলেও বিলুপ্তির পথে বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার বোর্ডঘরটি। এক হাজার ৬৪৩ দশমিক ৪৪ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্ববৃহৎ ছিটমহল দাসিয়ারছড়াবাসী বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হবার আগে এখানে চালু ছিলো ভিন্নধর্মী শাসন। রাষ্ট্রবিহীন অবস্থায় আইন ও সালিশকেন্দ্র হিসেবে প্রচলিত ছিলো বোর্ডঘরটি। ছিলো পঞ্চায়েত শাসন, বিচার ও পুলিশি ব্যবস্থা। দাশিয়ারছড়া বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হবার পরেও বোর্ডঘরের প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও ইতিহাস সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য বোর্ডঘরটি সংস্কারের দাবী এলাকাবাসীর।
বিলুপ্ত ছিটমহলের বান্দিারা জানান, দাসিয়ারছড়া ভারতের ভূখন্ড হলেও ভারতের সঙ্গে সংযোগ না থাকার কারণে এখানে ভারতের আইন শৃংখলা বাহিনী প্রবেশ করতে পারত না। ফলে জমিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দিলে তার নিস্পত্তি করা কঠিন হতো। তাই ছিটমহলের বাসিন্দারা নিয়ম শৃংখলা ঠিক রাখার জন্য ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নিজেরাই একটি কমিটি করে। গঠনতন্ত্র তৈরি করে এখানে চালুর করা হয় পঞ্চায়েত প্রথা। গঠনতন্ত্রে দাসিয়ারছড়াকে দু‘ভাগে ভাগ করেন তারা। একটি হল-উজানটারি অপরটি ভাটিয়াটারি। এ দু’টি টারি বা পাড়া আবার ৩টি মৌজায় ভাগ করা হয়। সেসময় দাসিয়ারছড়ার মোট ভোটার ছিল ১ হাজার ৯০০ জন। কিন্তু ভোটার তালিকায় শুধু পুরুষেরাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারত। মহিলাদের ভোট ছিল না। গঠনতন্ত্রে আরও একটি বিষয় ছিল শুধু মাত্র উজানটারির লোকরাই পঞ্চায়েত প্রধান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। কিন্তু ভাটিয়াটারির লোকজন শুধু মাত্র ভাইস-চেয়ারম্যান পদে লড়তে পারতেন।
ছিটমহল আন্দোলনের নেতা মো: আলতাফ হোসেন, দাসিয়ারছড়ার সাবেক পঞ্চায়েত প্রধান নজরুল ইসলাম ও স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ হোসেন, মোজাফ্ফর রহমান, জহুর আলীসহ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ৬০ এর দশকে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য প্রধান কার্যালয় হিসাবে ২৫ শতাংশ জমিতে আইন ও সালিশ ঘরটি (বোর্ড ঘর) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই ঘরটিতে বিচারক কক্ষ, সভাকক্ষ ও আসামী রাখার কক্ষ নামে ৩টি কক্ষ ছিলো। দাসিয়ারছড়ার আইন শৃংখলা ঠিক রাখার জন্য মোট ৯৪ জনের সমন্বয়ে ভিডিপি (গ্রাম নিরাপত্তা বাহিনী) গঠন করা হয়। এদের মধ্যে একজন উইং কমান্ডার ও ৩ জন সেক্টর কমান্ডারের মাধ্যমে ভিডি পার্টি পরিচালিত হতো। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ভিডিপি দিয়ে ধরে এনে এই বোর্ড ঘরে আটকে রেখে বিচারকার্য পরিচালনা করতো দাসিয়ারছড়া পঞ্চায়েতের সদস্যরা। সাধারণত বিচারের রায়ে জরিমানা প্রথা চালু ছিলো। এমনকি খুনের শাস্তি হিসেবে আর্থিক জরিমানা করা হতো।
কালের স্বাক্ষী ঐতিহাসিক আইন ও শালিস ঘরটি (বোর্ড ঘর) আজ বিলুপ্তির পথে। সরেজমিন দেখা গেছে আধাপাকা ঘরটির দরজা জানালা ভেঙে গেছে। ভেতরের কাঠগড়া ও বিচার ব্যবস্থার অন্যান্য চিহ্ন নেই। এলাকাবাসী মনে করেন, এই ঘরটি সংস্কার করে সরকার সংরক্ষণের উদ্দ্যোগ নিলে ভবিষ্যত প্রজন্ম ছিটমহলের প্রকৃত ইতিহাস ও শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবে বলে মনে করেন এলাকাবাসী।
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ইন্দিরা-মুজিব স্থল সীমান্ত চুক্তিটি ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে বাস্তবায়ন হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল দুই-দেশের ভু-খন্ডে যুক্ত হয়। ফলে উভয় দেশের নাগরিক হবার সুযোগ পান অবরুদ্ধ ছিটমহলের বাসিন্দারা।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা খাঁন বলেন, ‘আমরা বহু আন্দোলন করেছি দাসিয়ারছড়াকে আলাদা একটি ইউনিয়ন করার জন্য। কিন্তু তা হয়নি। এই বোর্ড ঘড়টি দাসিয়ারছাড়ার বিচার ও আইন ব্যবস্থার কালের স্বাক্ষী। সরকারের কাছে জোর দাবী-বোর্ড ঘরটির সংস্কারপুর্বক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। লাইব্রেরিও মিউজিয়াম করে জায়গাটি সংরক্ষণ করে রাখলে পর্যটকদের যেমন ভীড় বাড়বে- তেমনি সরকার রাজস্ব আয়ও করতে পারবে।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তৌহিদুর রহমান জানান, বিষয়টি বিস্তারিত জেনে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!