ভাঙনের সাক্ষী তিস্তাপাড়ের নারিকেল গাছ

সাইমুল ইসলাম সাজু :
নন্দিত সাহিত্যিক আবু ইসহাকের “সূর্য-দীঘল বাড়ি” উপন্যাসে সূর্য-দীঘিল বাড়িটির বড় আকর্ষণ ছিল তালগাছ। গ্রামের অনেকের পরিচয় ছিল এই তালগাছটির সাথে, তারা আজ নেই। কিন্তু তালগাছটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মত। কালের সাক্ষী হয়ে শত ঝড়ঝাপটা উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা উঁচু করে।

ইতিহাসের স্বরণ কালের ভাঙনের মুখে পড়ে তিস্তাপাড়ের মানুষ। গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ভরা তিস্তার পেটে। বসতভিটা হারিয়ে অনেকে পাড়ি জমায় তিস্তার গর্ভে জেগে ওঠা বালুর চরে অজানা গন্তব্যে। “সূর্য-দীঘল বাড়ি” উপন্যাসের তালগাছটির মত তিস্তার ভাঙনের সাক্ষী হিসাবে তিস্তার গর্ভে মাথা ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুলে-ফলে ভরা নারিকেল গাছ।

নারিকেল গাছটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ পাড়ি জমায় তিস্তা পাড়ের গতিয়াশ গ্রামে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নারিকেল গাছটি নিয়ে অনেকের অনেক মন্তব্য চোখে পড়ে। কেউ লেখেন অলৌকিক ঘটনা! আল্লাহ পাকের অশেষ কুদরতি। তিনি চাইলে কি না করতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেশ ব্যাপী নারিকেল গাছের ছবি ছড়িয়ে গেছে। ফেসবুকে নারিকেল গাছটির ছবি দেখে অনেকে নিজ চোখে দেখার জন্য আসছেন। স্থানীয়দের কাছে আগতরা নারিকেল গাছটি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয়রা তিস্তার জল চোখে নিয়ে নারিকেল গাছটির দিকে হাত দেখিয়ে বলেন, “ওটা করিম মিয়ার বাড়ির গাছ।”

করিম মিয়া (৫৫)। সাধারণত তিনি পানের ব্যবসা করেন। কোন রকমে দিন চলে। বাড়িতে গরু পালনও করেন তিনি। ৪ ভাইয়ের মধ্যে করিম মিয়া বড়। পৈতৃক সম্পত্তি ছোট ভাইদের কাছে বিক্রি ও ৪ টা গবাদিপশু (গরু) বিক্রির টাকায় ৬৫ শত জমি কিনেন। সেখানে গড়ে তুলেছেন সুখের সংসার। কখনো কল্পনাও করেননি তিস্তার গর্ভে হারিয়ে যাবে তার সাজানো সংসার।

করিম মিয়ার বসতভিটা সহ নিজ জমি ৬৫ শতক। বন্ধকী জমির পরিমাণ ৪৫ শতক। ৪৫ শতক বন্ধকী জমির মধ্যে ২০ শতকের আমন খেত, ২৫ শতকের বিদেশী ঘাসের খেত নদীতে। বসত বাড়ির ৬৫ শতকের মধ্যে ৪৪ শতক জমিতে পুকুর করেছেন। বাকি ২১ শতকে সুপারি বাগান, বেশকিছু ফলের গাছ লাগিয়ে ছিলেন। বাঁশঝাড় ৬টি, আম গাছ ১০টি, কাঁঠালগাছ ২টি, জাম্বুরা গাছ ২ টি সহ কয়েক প্রকার ফল ও কাঠের গাছ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে৷ বাঁশঝাড়ের বাঁশ তিস্তার বুকে স্রোতে এলিয়ে দুলিয়ে ইশারা করছে।

করিম মিয়ার বসতভিটার যে দুটি গাছের কথা না বললে নয় সেটি হলো নারিকেল গাছ। করিম মিয়ার ২টি নারিকেল গাছের মধ্যে ২টি গাছেই তিস্তা তার ভাঙনে কেড়ে নেয়। একটি নারিকেল গাছ স্রোতে হারিয়ে গেলেও আরেকটি নারিকেল গাছ তিস্তার অগ্রাসী ভাঙনের সাক্ষী হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিস্তার বুক চিঁড়ে।

তিস্তার ভাঙনে সর্বহারা হয়ে করিম মিয়ার ঠাঁই হয়েছে ছোট ভাইয়ের কাছে বিক্রি করা পৈতৃক বসতভিটায়। কিছুদিন ঘরের জিনিসপত্র, পরিবারের লোকজন নিয়ে ভাইয়ের জায়গায় ঘর তুলে আছেন। নদীর চর ভাসলে সেখানে যাবেন। অন্য প্রতিবেশীরা চরে গেলেও করিম মিয়ার টাকা পয়সা না থাকায় চরে যাওয়া হয়নি।

করিম মিয়া বলেন, “আশপাশের ৮/৯ টা নারিকেল গাছ সহ শতশত গাছ নদীতে বিলীন। আল্লাহ পাকের কি ক্ষমতা! অলৌকিকভাবে এখনো আমার নারিকেল গাছটি দাঁড়িয়ে আছে।” বলেই কেঁদে ফেলেন।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!