হাঁকাও গাড়ি চিলমারী বন্দরে

আব্দুল খালেক ফারুকঃ
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে-’ ভাওয়াইয়া সম্রাট খ্যাত আব্বাস উদ্দিনের এই গান বিখ্যাত করেছে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরকে। তবে চিলমারী বন্দরের সেই হাকডাক এখন নেই। তা সত্বেও ভারতের আসাম ও কলকাতা রুটের মাঝখানে ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে ব্রহ্মপুত্র পারের চিলমারী বন্দর।

আরব বণিকরা
প্রাচীনকাল থেকে চিলমারী প্রসিদ্ধ নদী বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। ইতিহাসে বর্ণিত আছে আরব বণিকরা এই বন্দর ব্যবহার করে মধু, সুগন্ধি, রেশমি বস্ত্র ও মণি-মুক্তা ক্রয় বিক্রয় করতেন। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির তিব্বত অভিযানের পথ, সুবেদার মীর জুমলার আসাম অভিযানের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৫৮০ সালের দিকে কোচবিহারের মহারাজা বিশ^সিংহের পুত্র রাজা নরনারায়ন ও সেনাপতি রাজা চিলরায়ের স্মৃতি বিজরিত স্থান হিসেবে চিলমারী বন্দর পরিচিত লাভ করে। ১৪৪৩ সাল থেকে ১৫১৯ সালের দিকে চিলমারীতে তৈরী হয়েছিল বড় বড় নৌ যুদ্ধ জাহাজ এবং সেগুলো রফতানিও হতো। নানা কারণে বন্দরের গুরুত্ব ঐতিহাসিক।

পাটের কারবার
এক সময় পাটের কারবারের জন্য বিখ্যাত ছিল কুড়িগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দর। ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই বন্দর পাট বেচাকেনা, প্রসেসিং, দেশী-বিদেশী জাহাজের আসা-যাওয়া, দেশের নানা অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ী ও পাইকারদের আনাগোনায় মুখরিত ছিল রাতদিন। এখাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যমতে, চিলমারী বন্দরের পাটের কারবার শুরু হয় তিরিশের দশকে। সীমান্তের ওপারের আসামের সাথে এক সময় ফেরি সার্ভিস ছিল। ৩০টি পাটকল ও কম্পানি এখানে কারবার খুলে বসে। স্থাপন করে বিশাল পাট গুদাম। পাট প্রসেসিং ও বেল তৈরীর মেশিন স্থাপন করা হয়। পাট ক্রয়, বাছাই ও বেল তৈরীর কাজে নিয়োজিত ছিল সহ¯্রাধিক শ্রমিক। এর বাইরে শত শত ব্যাপারী কৃষক ও ফড়িয়াদের আগমন হতো এখানে। প্রায় ৩০০ গরুর গাড়ি দূর-দূরান্ত থেকে পাট আনতো এখানে। এখানকার পাট খুলনা, দৌলতপুর, নারায়নগঞ্জ ও চট্রগ্রামসহ নানা জায়গায় সরবারহ করা হতো। বিদেশেও রফতানি হতো এখানকার উন্নতমানের পাট।

ভাঙা গড়ার পালা
১৯৬৭ সালের দিকে বন্দর এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন তীব্র হয়ে ওঠে। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময় নিশ্চিহৃ হয়ে যায় বন্দরটি। লুটপাট হয় অনেক পাট কম্পানির মালামাল। দেশ স্বাধীন হবার পর বিলীন হওয়া বন্দরের ৩ কি. মি. দুরে রমনা বাজারে কয়েকটি গুদাম ও অফিস নির্মাণ করে আবারও সীমিত আকারে হলেও শুরু হয় পাটের কারবার। এক পর্যায়ে বেসরকারি পাট কোম্পানীর উপর পাট রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা, সীমিত ব্যাংক ঋণ সুবিধাসহ নানা কারণে ধীরে ধীরে চিলমারীর ঐতিহ্যবাহী পাটের কারবারে জ্বলে ওঠে লাল বাতি। রমনা বাজারের একাংশও ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। নতুন করে চিলমারী বন্দরের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান চিলমারী নৌ বন্দরের উদ্বোধন করেন। একটি পল্টুন আসে। কিছু জরিপ ও খননের কাজও হয়। চিলমারী বন্দর হতে দৈ খাওয়া বা সাহেবের আলগা নৌ পথে ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় ভারতীয় নৌযান চলাচলের সুবিধার্থে নৌ পথ নির্দেশক নৌ -চিহৃ স্থাপনের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। তা সত্বেও গত এক বছরে বন্দরের অগ্রগতি সামান্যই। তবে রৌমারী, রাজীবপুর, যাত্রাপুর, হাতিয়া, অষ্টমীরচরসহ নানান জায়গা থেকে বড় বড় ছইতোলা নৌকা আসছে প্রতিনিয়ত।

আসাম টু কলিকাতা
কুড়িগ্রামের সীমান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্রের নৌ রুটে ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ সীমিত আকারে আসাম থেকে কলকাতা যাতায়াত করে । কিন্তু নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় এই রুটে জাহাজ আসার সংখ্যা কমে গেছে। ভারতের জাহাজগুলো মূলত: এই পথে আসামের শীলঘাট থেকে চাঁদপুর-বরিশাল হয়ে কলকাতা যায়। এছাড়াও ভারত বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জ থেকে সিমেন্ট আমদানি করে এই রুট দিয়ে। তাদের এই পথ প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। চিলমারীতে রাজস্ব আদায়ের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি শুল্ক ষ্টেশন রয়েছে। বর্তমানে মাসে একটির বেশী জাহাজ আসেনা। জাহাজের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়ায় বন্দরের কোন কর্মমুখরতা নেই।

প্রবীনদের স্মৃতিতে
চিলমারীর সোনারীপাড়ার ৯০ বছরের বৃদ্ধ সাজিমুদ্দিন। চিলমারী বন্দরের ষ্টিমারের হুইসেলের শব্দ যেন আজো কানে বাজে তার। এক সময় কয়লার রেলগাড়ির টানা লম্বা শীষ টানা হউইসেলের শব্দে ঘুম ভাঙতো চিলমারীবাসীর। নদীতে ষ্টিমারের হইসেল, যাত্রীদের হুড়োহুড়ি, পালতোলা নৌকার মাঝিদের যাত্রী সংগ্রহের আহবান, হকারদের চিৎকার, হোটেলগুলোর চুলো ধরানোর ধুম- স্মৃতির ডালা খুলে সেই সব দিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। চোখ-মুখের উপর ঝিলিক দেয় সোনালী আভা। জানান, তাদের শৈশবে খুব কর্মচঞ্চল ছিল চিলমারী বন্দর। বড় বড় ষ্টিমারের আনাগোনার সাথে নানান পণ্যের কারবারি ব্যবসায়ীদের ভিড়ে মুখরিত ছিল বন্দর। সারি বেঁধে গরুর গাড়ি চলতো। চাকার ক্যারোৎ ক্যারোৎ শব্দের সাথে গাড়োয়াদের ভাওয়াইয়া গান মিলিয়ে এক ধরণের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতো। ষ্টিমার, গরুর গাড়ি, গাড়োয়ানদের গান-এখন কেবলই স্মৃতি। এখন অনেকটাই বেকার ইমদাদুল, মমিনুল ও সিরাজুলের মতো অনেক বন্দর শ্রমিক।

হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র
শুষ্ক মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র কয়েকটি ধারায় প্রবাহিত হয়। মাঝে মাঝে জেগে ওঠে চর। সেই চর ও দ্বীপচরগুলি কাঁশফুলে ছেয়ে যায়। বিস্তৃত জলরাশির সাথে কাঁশফুল বিস্তৃতি লাভ করে দিগন্তে মিলিয়ে যায়। শেষবেলায় দিগন্তে ভেসে ওঠে মেঘালয়ের পাহাড়। ভ্রমন পিপাসুরা এই অপরুপ দৃশ্য দেখতে নৌ ভ্রমন করে এখানে। শীতকালে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখীরা ছুটে আসে এখানে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী শাসন প্রকল্পের কারণে চিলমারী ব্রহ্মপুত্রের ডান তীর এখন মোটামোটি সংরক্ষিত। পিচিং করা বøকের সরু রাস্তা দিয়ে নদের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বন্দরের উত্তর ও দক্ষিণে হেঁটে হেঁটে যাওয়া যায় কয়েক কিলোমিটার। অথবা ঘন্টা চুক্তিতে নৌকা ভাড়া নিয়ে ব্রহ্মপুত্রে নৌ ভ্রমনের রয়েছে অপূর্ব সুযোগ। বালুচরের উপর নীলাকাশ, তুষার শুভ্র কাঁশফুলের ঘন বন দেখতে দেখতে ছুটে চলার আনন্দটা অন্যরকম হতে পারে। সেই সাথে রৌমারী ও রাজীবপুরে নৌকাযোগে গিয়ে মেঘালয় ও আসাম সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে আসার সূবর্ণ সুযোগটা আসতে পারে হাতের মুঠোয়। ঈদের সময় চিলমারীসহ আশেপাশের হাজারো বিনোদনপ্রেমী ভিড় করেন চিলমারী বন্দরে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!