হায় মনোনয়ন! হায় মার্কা


১.
পার্টির মনোনয়নপত্রটি হাতে নিয়ে একদৃষ্টে মিনিট পাঁচেক তাকিয়ে রইলেন আবুল হোসেন। চশমার নিচে কয়েকদিনের নির্ঘুম থাকার কারণে লালচে হয়ে ওঠা চোখ দুটো ভিজে গেছে। এই অশ্রু কষ্টের না আনন্দের বুঝতে পারছেন না আবুল হোসেন। হায় মনোনয়ন! এই কাগজখানা বাগাতে পেরে এতো মূল্য দিতে হবে কে জানে? চারিদিকে চাউর হয়েছে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে আবুল এই মনোনয়ন হাছিল করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ফিগারটা তিনিই জানেন। ঘাটে ঘাটে কতযে কড়ি ফেলতে হয়েছে। এমনকি জনদরদি পার্টির মহাসচিবের দৈনিক হাতখরচ, পানীয় বিল, চেলা চামুন্ডাদের হোটেলে থাকা-খাওয়া-এমনকি দাড়ি সেভ করার টাকাও গুণতে হয়েছে নগদে। সব কিছু নিরবে সইতে হয়েছে এই কাগজখানার জন্য। এই কাগজখানা পাওয়া মানে মার্কা পাওয়া আর মার্কা পাওয়া মানে পীরের দোয়ায় এমপি হওয়া। ভাবা যায়! তবে আবুল হোসেন ব্যবসায়ী মানুষতো। তাই আয়-ব্যয়ের হিসাব কষছেন। চন্দ্র হাতে পাবার পর টাকার জন্য কিছুটা আফসোস হচ্ছে।
আফসোস হবেই না বা কেন? আবুল হোসেনের আজ এতো অর্থ-বিত্ত আগে কি ছিল? বাবার ছিল একটি গরুর গাড়ি। উপার্জনের একমাত্র পথ। বাবার সাথে গাড়ি টানতে গিয়ে লেখাপড়াটা আর হলো কই? ব্যবসা করার মতো কিছু বিদ্যা শেখা আছে বলে রক্ষা। তবে মা লক্ষী কখনও তার ব্যবসায় বাগড়া দেননি বলে ধাই ধাই করে উন্নতি হয়েছে ব্যবসায়।
এক বন্ধুর বুদ্ধিতে প্রথমে ব্যাঙের ব্যবসা ধরেছিলেন আবুল হোসেন। টাকা পয়সাও বেশ কামাচ্ছিলেন। কিন্তু লোকে নাম দিলো ব্যাঙ আবুল। বাধ্য হয়ে নামটি কাটতে ধরলেন আলুর ব্যবসা। কিন্তু এখানেও টাকা বানালেও নতুন নামকরণ হলো আলু আবুল। ফলে নাম বিড়ম্বনায় একে একে ব্যবসা বদল করে গাড়ি আর বিড়ির ব্যবসায় যশ খ্যাতি কামালেন। প্রচুর বিত্ত বৈভবের মালিক হবার পর নাম লেখালেন রাজনীতিতে। এরপর লোভ জাগলো এমপি মন্ত্রী হবার। খোয়াবে হাজির হলেন পার্টি চেয়ারম্যান কেয়ামত আলী। তারপর নজরানা দিয়ে তার মুরিদ হতে হলো। এনার মতো কামেল মানুষকে নেতা না বলে পীর বলাই সংগত।
কিন্তু আবুল হোসেনের মতো পার্টির আর এক মনোনয়ন প্রার্থী আক্কেল আলীর সামনে মহামুসিবত। পার্টি অফিসের সামনে লালসালু বিছিয়ে ভিক্ষায় নেমে গেছেন আক্কেল। এছাড়া উপায় কী? বাড়িভিটা বিক্রি করে ৬০ লাখ টাকা গুণে দিয়েছিলেন মহাসচিবের হাতে। মুসলমানি জবান দিয়েছেন মহাসচিব, কাজেই মনোনয়ন ফস্কে যেতে পারেই না। সকালে ক্লিনসেভ করে নতুন কেনা কোট পরে মনোনয়নপত্র নিতে গিয়ে দেখেন, অফিসের চেয়ার-টেবিল উল্টে পড়ে আছে। দুরমুজ পার্টির ডাইরেক্ট এ্যাকশন চলছে। পার্টির চেয়ারম্যান, মহাসচিব ও সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে সমানে শ্লোগান চলছে। টাকা ফেরৎ চেয়ে মাতম করছে কয়েকজন। মহিলারা কোমর বেঁধে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কেউ কেউ হুমকি দিচ্ছেন টাকা আদায়ের। কেউ কান্নাকাটি করছেন। অথচ মহাসচিব লা পাত্তা। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। পার্টির চেয়ারম্যান সোজা ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। সেই সুযোগে নমিনেশন বাণিজ্য করে মোটা টাকা বানিয়ে নিয়ে তিনি গুপ্তস্থানে চলে গেছেন। শোনা যাচ্ছে মহাসচিবের চাকুরি নট হয়েছে। অফিসে ঝুলছে বিরাট সাইজের তালা।
এসব দেখে আক্কেল আলী কখন যেন ফিট হয়েছিলেন। রাস্তায় পড়ে ছিলেন, কেউ তাকিয়ে দেখেনি। জ্ঞান হবার পর নিজেকে আবিস্কার করেন ফুটপাতে। রাত কটা বাজে জানেননা। হু-হু ঠান্ডা বাতাস কাবু করছে বুড়ো শরীর। পাশেই এক দরগায় গিয়ে আশ্রয় নিয়ে মুরিদবেশে আছেন। লালসালু বিছিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন। এখন তার অবস্থা হয়েছে লাইলী মজনু ছবির নায়ক মজনুর মতো। দাড়ি-গোঁফ চুলে দারুণ গেটআপ হয়েছে। আশা করছেন- যদি অফিস খোলে, আর যদি মহাসচিব আসেন; বাগে পেলে তাকে এমনভাবে ধরবেন-যে মনোনয়ন বাণিজ্য করার স্বাদ চিরতরে মিটিয়ে দিবেন।
২.
ফুটবলের দল বদলের মতো ভোটের মৌসুমে দলবদল এবার মহামারী রুপ নিয়েছে। যিনি সারাজীবন বঙ্গবন্ধু নাম নিতে মুখে ফেনা তুলেছেন, তিনি ঠাঁই নিয়েছেন প্রতিপক্ষের শিবিরে। আবার শহীদ জিয়ার একনিষ্ট অনুসারী দাবিদার ময় মুরুব্বিরা মার্কার লোভে নাম লিখিয়েছেন আওয়ামীলীগে। তোরা যে যা বলিস ভাই-আমার মার্কাটা চাই।
তা আমাদের এলাকার এক্্র অফিসার মজবুত আলী ভাবলেন মার্কাটা না হলে জীবন বৃথা। তাই আদর্শ, নীতিকে দু’পায়ে মাড়িয়ে চলে গেছেন বিপরীত শিবিরে। মার্কার জন্য নীতি কুরবান। সত্তর পেরিয়ে ৮০ ছুঁই ছুঁই বয়সে বুড়ো ভামদের আসরে গিয়ে ভিড়লেন। মার্কার জন্য ডিগবাজি দিলেন আওয়ামীলীগ থেকে গণফোরামে। কিন্তু বিধি বাম। ওনার আগেই নাকি মার্কা বুক করেছেন আরেকজন। তিনিও ডিগবাজি দিলেন যথাসময়ে। এক্্র দুজনে বক্্িরং শুরু হবে বলে! তারও আগে থেকে এই মার্কা বুকিং দিয়ে তসবি জপছেন দুই নেতা। তাহলে দুইয়ে দুইয়ে চার। পুরো টিমে এখন কে কাকে ল্যাং মারে কেন জানে। বুড়ো হাড্ডিতে ল্যাং খেলে এ যাত্রা কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবেন কীনা সে হুস নেই মজবুত আলীর। হায় মার্কা! হায় মনোনয়ন। তোমার জন্য বঙ্গদেশে আর কত রঙ্গ দেখবো।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!