মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার

বিভাস প্রতিবেদক:
৬৭ বছর আগে নির্মিত কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনারটি আজো স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কুড়িগ্রাম মজিদা আদর্শ ডিগ্রি কলেজের প্রবেশ গেটের বামদিকে এই শহীদ মিনারটি দেখা যায়। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই শহীদ মিনারটি সম্পর্কে না জানলেও এই শহীদ মিনার নির্মাণের রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস।
কুড়িগ্রামের ভাষা সৈনিক সামিউল হক নান্টু জানান, ‘৫৩ সালে শহীদ দিবসের আগের দিন এ্যাডভোকেট আমান উল্ল্যাহ, সাংবাদিক তোফায়েল হোসেন, সামিউল হক নান্টু, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হামিদ, হিমাংশু রায়, বুদ্ধু দেব সরখেল, জয়ন্ত রুদ্র, অ্যাডভোকেট আসাদসহ কয়েকজন মিলে কুড়িগ্রাম গওহর পার্ক মাঠে (এখন মজিদা আদর্শ মহাবিদ্যালয় মাঠ) একটি শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ব্যবসায়ী আনছার মিয়া ও মকবুল হোসেনের কাছে ইট ও বিভিন্ন জনের কাছে চাঁদা তুলে তড়িঘড়ি করে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়; যাতে ২১ ফেব্রূয়ারি এই শহীদ মিনারে উদ্যাপন করা যায়। কিন্তু রাতের আঁধারে পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে দেয়। এতে উদ্যোক্তারা হতাশ ও হতদ্যম না হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পাহারা বসিয়ে শহীদ মিনারটি পুণরায় নির্মাণ করা হয়। পরদিন ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনারটি। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশার শত শত মানুষ শ্রদ্ধা জানান শহীদ মিনারে।
সময়ের বিবর্তনে এই শহীদ মিনারটিও অনুজ্জ্বল হতে থাকে। পরে মজিদা আদর্শ কলেজের কর্র্তপক্ষ এটিকে সংস্কার করে দৃষ্টিনন্দন করেন।
কুড়িগ্রামের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে স্মৃতিচারণ করে সামিউল হক নান্টু জানান, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহবান করে। কুড়িগ্রামের ছাত্রসমাজ এই ধর্মঘটকে সফল করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহন করে। ঢাকা থেকে এ সংক্রান্ত প্রচারপত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়। কুড়িগ্রাম হাইস্কুলের ছাত্র অ্যাডভোকেট আমান উল্ল্যাহ, আলী আফসার, আবুল ফজল, আফজাল হোসেন, মোস্তফা বিন খন্দকার এই ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেদিন কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের কুড়িগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম জুুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা মিছিলে অংশ নেন।
সামিউল হক নান্টু আরো জানান, ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামে ছাত্র ধর্মঘট, মিছিল ও সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল; কিন্তু ঢাকায় পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ভাষা সৈনিক নিহত হবার খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র জনতার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। ওই দিন রাতেই স্থানীয়ভাবে গঠিত ভাষা সংগ্রাম পরিষদের গোপন বৈঠক হাবিবুর রহমান খোকার বাসায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোস্তফা বিন খন্দকার সভাপতিত্ব করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন রেজা হোসেন খন্দকার, হাবিবুর রহমান, আব্দুল জলিল, আব্দুর নুর, আলী আসাদ, আয়নুল হক, যমেত আলী, এটিএম আফজাল, বাদল রুদ্রসহ অনেকেই। সভায় হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামে ধর্মঘট আহবান করা হয়। শহরে ঢোল পিটিয়ে প্রচারও করা হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাচ ধারণ করে নগ্ন পদে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছিলেন। ছাত্র জনতার মিছিলটি জাহাজ কোম্পানি মোড় পাড় হয়ে মুসলিম লীগ নেতা পনির উদ্দিনের বাড়ির সামনে এলে তিনি মিছিলকারীদের দিকে তেড়ে এসে বলেন ‘পাকিস্তান পাইছ, তোমরা সেটাকে ধবংস করতে চাও? আমরা মুসলমান, আমাদের ভাষা হবে উর্দু’। তাকে জুতা খুলতে বললে তিনি অকথ্য গালিগালাজ করে পুলিশকে মিছিল ভেঙে দেয়ার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ মিছিলে হামলা চালিয়ে বাদল রুদ্রুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ মিছিলে লাটিচার্জ করে এবং মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে কুড়িগ্রাম ১ নম্বর মাঠের স্কুলে মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভা আহবান করা হলে সেখানেও পুলিশ বাঁধা দেয়। পরদিন বাদল রুদ্রের মুক্তির দাবিতে আবারও মিছিল হয়। ৩ দিন পর তিনি ছাড়া পান। সেই থেকে আন্দোলনকারীদের পেছনে ছায়ার মতো ছিল পুলিশ।
মজিদা আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ খাজা শরিফ উদ্দিন জানান, ‘কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনারটি আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত। এজন্য আমরা গর্ববোধ করি। শহীদ মিনারটি সংরক্ষণের জন্য আমরা সবসময় সচেষ্ট আছি।’

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!