সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের শঙ্কা

সড়ক নিরাপত্তা, রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নতি সত্বেও মমতার ফাঁড়া কাটছেনা। শহর-গ্রামে অনেকের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে- চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্ট তার কোন অস্বস্তির কারণ নয়। বরং হিসেবের বাইরে থাকা বিজেপির উত্থান তাকে বেকায়দায় ফেলছে। বাধ্য হয়ে তিনি ঐক্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বামদের দিকে। এ নিয়ে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে বিশ্লেষণ আর আলোচনার ঝড় চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপি ও উগ্রপন্থি হিন্দু সংগঠন আরএসএস ‘রাম নবমী’ ‘হনুমান জয়ন্তী’ নামে নতুন নতুন এক উপলক্ষ পালন করছে। তাতে প্রকাশ্যেই অস্ত্র হাতে রাজপথে দেখা গেছে স্কুল-কলেজের ছাত্রদের। শুধু কলকাতায় নয়, মালদাহর মতো মুসলিম প্রধান এলাকাতেও হিন্দু ভক্তদের ঢলও নেমেছে। এতে চিন্তিত তৃণমুল। সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে অন্যরাজ্যের মতো মোদি ম্যাজিক দেখাতে উদগ্রিব শিবসেনার সমর্থকরা। আর এতেই বাড়ছে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা।
মমতার অভিযোগ, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশের ঘটনাকে বাংলার বলে চালানো হচ্ছে। ভুয়া প্রফাইলে একাউন্ট খুলে কুমন্তব্য করা হচ্ছে’। এই অপপ্রচারের জেরে এপ্রিলে পুরীতে জগন্নাথ মন্দির দর্শনে গিয়ে বিজেপির পান্ডাদের বিক্ষোভে পড়তে হয়েছে মমতাকে। বাধ্য হয়ে তাকে বলতে হয়েছে ‘আমি সাচ্চা হিন্দু’।
কলকাতায় ঘোরার সময় আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভার পারভেজ জানালেন, তাদের পাড়ায় আগে হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলেমিশে থাকতেন। এখন কোন সমস্য হলে আগে বিচার্য বিষয়- সে হিন্দু না মুসলিম। মুসলিম হলে তার ন্যায্য বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং নানা উস্কানিমুলক কথাবার্তা বাতাস দূষিত করছে। এটা শুধু কলকাতাই নয়, সারা পশ্চিম বাংলায়। আমি কলকাতা ছাড়াও মালদাহ, মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় কয়েকদিন অবস্থান করেছি। কথা বলেছি অনেকের সাথে। এসব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারপরেও তাদের হতাশার শেষ নেই। শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলমান বাস করলেও ব্যবসা বাণিজ্যে যথেষ্ট উন্নত মালদাহর সুজাপুরে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল, মাদ্রাসা থাকলেও একটি কলেজও নেই। এখানকার মুসলিম তরুণদের অনেকেই তাই উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আগে শিক্ষিত মুসলিমরা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে চাকুরি পেতোনা। এখন মমতা কিছু ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির সুযোগ দেয়ায় অনেকের চাকুরি হচ্ছে। তবে এতে বিগড়ে গেছে হিন্দুরা। সুযোগ নিচ্ছে বিজেপি। বলা হচ্ছে, মমতা মুসলমানদের স্বার্থ দেখছেন বেশী। তারা মমতাকে ‘মমতাজ বেগম’ বলে ডাকছেন। তার বংশ ও জন্ম পরিচয় নিয়ে নানা গালগল্প ছড়াচ্ছেন। বলা হচ্ছে, মমতার পূর্বপুরুষ মুসলিম ছিলেন। ফেসবুকে অনবরত মিথ্যাচার ছড়ানো হচ্ছে মমতার নামে। আর এসবের জবাব দিতে গলদঘর্ম তিনি। সভায় মন্ত্র-স্তোস্ত্র পড়ে নিজেকে খাঁটি হিন্দু প্রমাণের চেষ্টাও করতে হচ্ছে। তবে শুধু কোটার কল্যাণে চাকুরি পাবার আশা বাদ দিয়ে মুসলমানদের উদ্যোগে ‘মিশন স্কুল’ চালু করা হয়েছে স্থানে স্থানে। এখান থেকে পড়াশোনা করে অনেকেই পরবতিতে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ও ক্যাডার সার্ভিসে সুযোগ পেয়ে অনেকটাই স্বস্তি এনে দিয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের দৌলতপুর থেকে মালদাহ যাবার পথে এ রকম একটি মিশন স্কুল দেখলাম। পনের একর জমির ওপর তৈরী হয়েছে স্কুলটি। উদ্যোক্তা একজন মুসলিম চিকিৎসক। মালদাহ শহরে তার চেম্বার। আবাসিক এই স্কুলে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্ররা এসে এখানে শিক্ষালাভ করছেন।
সম্প্রতি মোদী সরকার পশু বিক্রয়, পরিবহন ও জবাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যদিও সায় নেই, তারপরেও সাম্প্রদায়িক শক্তি এ থেকেও রসদ নেয়ার চেষ্টা করছে। পশ্চিম বাংলায় গরু জবাই নিষিদ্ধ না হলেও হাট-বাজারে প্রকাশ্য বিক্রির সুযোগ নেই। গ্রামে গরু জবাই হলেও প্রতি কেজি বিক্রি হয় গড়ে ১০০ রুপি। বাংলাদেশ সীমান্তে কড়া প্রহরা। ফলে গরু লালন পালন করে সস্তায় বেচে লাভবান হতে পারছেনা কৃষকরা। মাঝারি ধরণের একটি গরু বিক্রি হচ্ছে ৭-১০ হাজার রুপিতে। অবশ্য লাভের অংক যাচ্ছে তাদের ঘরে, যারা গো মাংস রপ্তানি করছে বিদেশে। ভারতের শীর্ষ গোমাংস রপ্তানীকারকদের প্রায় সবাই হিন্দু। তাদের অধিকাংশই আবার বিজেপির সমর্থক। গোশালার নামকরণ করা হয় ইসলাম ধর্মের সাথে সংগতি রেখে। স্থানীয় সুত্রে এ ধরণের কয়েকটি গোশালার তথ্য সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে রয়েছে মুম্বাইয়ের সুনীল কাপুরের মালিকানাধীন এরাবিয়ান এক্্রপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড, দিল্লীর মদন এ্যাবোতের এমকেআর ফোজ্রেন ফুড এক্্রপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড ও চন্ডিগড়ের এমএস বিন্দ্রার মালিকানাধীন পিএমএল ইন্ডাষ্টিজ প্রাইভেট লিমিটেড। গরুর মাংস নিয়ে এ ধরণের তেলেমাতি ও দরিদ্র মানুষকে ধোকা দেয়ার ঘটনাটি মুসলমানরা জানলেও সাধারণ হিন্দুরা কতটুকু জানে বা জানলেও আমলে নিচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। বরং সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে হিন্দুদের ভোট বাক্্ের টানার কৌশল অনেক রাজ্যে সফল হয়েছে বিজেপি। মুসলিম ভোট বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আর তৃণমুলের মধ্যে ভাগাভাগি হচ্ছে। আর হিন্দুভোট একাট্রা করতে অনেকটাই সফল হচ্ছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গেও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা স্থানীয় মুসলিমদের। এ ক্ষেত্রে আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
ইতোমধ্যে দু’একটি জায়গায় সেরকম আলামত দেখা যাচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর তালে আছেন বিজেপি, আরএসএস ও শিবসেনার পান্ডারা। এ নিয়ে পশ্চিবাংলার শিক্ষিত সমাজের মধ্যে উৎকন্ঠা বাড়ছে। তবে সবচেয়ে বেশী ভয়ে আছেন মুসলিম সম্প্রদায়। সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হলে ক্ষতির মুখে পড়বেন তারাই। তার বড় ক্ষতি হবে পশ্চিমবাংলার অসাম্প্রদায়িক ইমেজের।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!