শহর কলকাতায় অচেনা অতিথি


আন্ত:নগর শতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেনটি মালদাহ থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেল সকাল ৮-৫০ মিনিটে। ট্রেনটি ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায় ৮-৪৫ মিনিটে। আমরা অপেক্ষমান ছিলাম আগে থেকেই। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ট্রেনের আগমন আর গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। জানতে পারলাম বেশীরভাগ দ্রুতগামী এক্সপ্রেস ট্রেন এভাবেই শিডিউল মতোই চলাচল করে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনের কামড়ায় ঢুকেই পারিপার্শিকতা দেখে মন ভরে গেলো। আমার সঙ্গী মালদাহর ব্যবসায়ী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা টুনু ভাই। তার সাথে ষ্টেশনেই আমার প্রথম পরিচয়। আমেরিকা প্রবাসী আমার সুহৃদ চৌধুরী সফিউদ্দিনের সম্পর্কে জামাই তিনি। আমার কলকাতা ভ্রমন যেন নিরাপদ ও সহজ হয়, সেজন্য আংকেল সফিউদ্দিন তাকে আমার ভ্রমন সঙ্গী নির্বাচন করে দিয়েছেন। ট্রেনে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো রেল কর্তৃপক্ষের আতিথেয়তা। অনেকটা জামাই আদরের মতো। কয়েক দফায় বাটার, ওমলেট, চা, ভাত, ডাল, চিকেন, দইসহ আরো কত কী খাবার নিয়ে রেল কর্মীরা হাজির সিটের সামনে। শেষ বার আইসক্রিম দিয়ে আপ্যায়ন পর্ব চুকে গেল। বাংলাদেশের ট্রেনের সাথে তখন সংগতি-অসংগতির হিসাব মিলাচ্ছিলাম। বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণি ও কেবিনে ভ্রমন করেও এমন সেবা পাওয়া কল্পনা। কবে আমরা আমাদের দেশে ট্রেনের এমন সার্ভিসসহ নিরাপদে ভ্রমন করতে পারবো ভাবছিলাম। আপ্যায়ন আর টুনু ভাইয়ের সাথে আলাপে কখন যে সাড়ে ৫ ঘন্টা সময় কেটে গেল! মাঝখানে বিহারের একটি এলাকায় ট্রেনে গরু কাটা পড়ায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ট্রেনের বিলম্ব হয় প্রায় আধাঘন্টা। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খন্ড রাজ্য স্পর্শ করে ট্রেনটি দুপুর আড়াইটায় কলকাতার হাওড়া ষ্টেশনে এসে থামলো। ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নেমেই চোখে পড়লো বিশালযজ্ঞ। ২০টি প্লাটফর্র্মে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন আসছে। ছেড়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার যাত্রীর ওঠানামা, হাঁটা চলা, ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকা-সব মিলে এলাহী কারবার। একই দৃশ্য দেখেছি সন্ধ্যায় শিয়ালদহ ষ্টেশনে। বিচিত্র ভাষা আর বর্ণের মানুষের স্রোত যেন থামছেই না।
হাওড়া ষ্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে বাসে শিয়ালদহ রওয়না হলাম। পথে ভিড় কম, সহনীয় জ্যাম। দ্রুতই পৌঁছে গেলাম শিয়ালদহ। এরপর হোটেল খোঁজার পালা। তীব্র গরমে লাগেজ বহন করে হোটেল খুঁজতে গিয়ে পেরেসান হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, আমার বুক পকেটে রয়েছে পাসপোর্ট-ভিসা। কাজেই ভাবনা কী! কিন্তু অভিজ্ঞতা ভিন্ন। ৩-৪টি হোটেল ঘুরে সিট না পেয়ে একটি হোটেলের রিসিপসনে গিয়ে হাজির হলাম। ম্যানেজার ভদ্রলোক বয়স্ক মানুষ। লিকলিকে চেহারা। কাকা বাবু টাইপের চরিত্র। রাশভারি প্রকৃতির। কথা কম বলেন। বললেন, আধাঘন্টা পর রুম খালি হবে একটি। কী আর করা। রিসিপসন রুমে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছি। কিন্তু রুম খালি হবার পর রেজিষ্ট্রেশনের সময় বাংলাদেশী পাসপোর্ট মেলে ধরতেই তিনি যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। বললেন, বাংলাদেশি রাখার অনুমতি নেই। জানলাম, কলকতার সব হোটেলের বাংলাদেশি রাখার অনুমতি নাকি নেই। এ কথা শুনেই বেড়ে গেল হতাশা। তীব্র গরমে একের পর এক হোটেলে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অবশেষে একটি হোটেলে নন এসি একটি রুম মিলল। হোটেলের নাম খাদিজা হোটেল। রুমের ভাড়া পনেরশ’ রুপি।
হোটেলের রুমে টিভি ছেড়ে দিতেই দেখা গেল আনন্দবাজার গ্রুপের একটি নিউজ চ্যানেলে নদীয়ায় এক সভায় পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে ধমক দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। বলছেন, “একের পর এক সীমান্ত পার হয়ে এসে দুর্বত্তরা খুন করে যাচেছ। আপনারা করছেন কী?” বুঝলাম কেন বাংলাদেশীদের এরা হোটেলে রাখতে চায়না। বাংলাদেশের অনেক জঙ্গি ও সন্ত্রাসী পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেয় বলে স্থানীয় প্রশাসনের ধারণা।
তীব্র গরমে আধা সিদ্ধ হয়ে কোনমতে রাত কাবার করে পরদিন সকালে ছুটলাম কলকাতার এ্যাপোলো হাসপাতালের দিকে। রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। শুধু সিগন্যালে থামতে হলো। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে পথে অনুন্নত জীবনযাত্রা ও বস্তি দেখে ছবি তুলতে লাগলাম। টুনু ভাই তখন বারবার বলছিলেন, ‘আরে- এটাতো মূল কলকাতা শহর নয়। এ এলাকা বলা যায় গ্রাম।’ বুঝলাম নিজ দেশের দৈন্যতা একজন বিদেশীর কাছে প্রকাশ করতে চান না তিনি। হয়তো এর নাম দেশপ্রেম। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভিজিট ৮০০ রুপি। বিদেশী হিসেবে রেজিষ্ট্রেশন ফি ২০০ রুপি। চিকিৎসকের কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র আর ওষুধ নিয়ে আমরা কলকাতা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমেই কলকাতা জাদুঘর। টিকিট কাটতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। স্থানীয়দের জন্য প্রবেশ মূল্য ২০ রুপি। আর বিদেশীদের জন্য ৫০০ রুপি। অভিন্ন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অংশ হয়েও বিদেশী হয়ে গেলাম। কী আর করা! কলকাতা জাদুঘরে ভারতীয় ও মিশরীয় সভ্যতাসহ নানা সভ্যতার নানা নিদর্শন রয়েছে। রয়েছে অনেক বিলুপ্ত প্রাণির ফসিল। রাজা-বাদশাদের ব্যবহৃত জিনিষপত্র, প্রাচীন গ্রন্থ, চিত্রকলা ও মুখোশের বিরল সংগ্রহ।
জাদুঘর থেকে বেরিয়েই ফুটপাতে দেখা গেল ভ্রাম্যমান খাবারের হোটেল। আওয়াজ আসছে-‘চাউল সাবজি আইয়ে-বঠিয়ে।’ দেশী বিদেশী অনেকের সাথে সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। তবে লক্ষ্য করলাম কলকাতার বাঙালিরা বাংলার চেয়ে হিন্দি বলতে বেশী পছন্দ করে। অজুহাত-এই শহরে বিভিন্ন রাজ্যের লোক আসে। জানিনা কিছুদিন পর বাংলায় বাংলা ভাষার কদর কতটুকু থাকবে। নাকি এরা বাংলা বলতে ভুলে যাবেন।
পোশাকেও আধুনিকতার ছাপ সুষ্পষ্ট। বিশেষ করে মেয়েদের অনেকেই আধুনিক পোশাক পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। যস্মিন দেশে যদাচার। এ নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। তবে খটকা অন্য জায়গায়। কয়েকজন তরুণিতে দেখলাম টি শার্ট-টাইট প্যান্ট পড়ে মুখ ঢেকেছেন হিজাবে। এ কেমনতরো পর্দা! টুনু ভাইকে জিঙ্গেস করে রহস্য জানলাম। আসলে পর্দার জন্য মুখ ঢাকা নয়-রোদে মুখ পুড়ে যাবার ভয়ে এমন আদিখ্যেতা। দুুপুরের খাবারের পর টুনু ভাই নিয়ে গেলেন ধর্মতলায়। সেখানে ফুটপাতের নানা পণ্যের পসরা। দাম তুলনামুলভাবে কম। অনেকটা ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার মতো। তবে ঢাকার মতো জ্যাম বা ভিড় বাট্রা নেই। কয়েকটি সুপার শপে আমাকে নিয়ে গেলেন টুনু ভাই। কেনাকাটার চেয়ে বড় উদ্দেশ্য আমাকে কলকাতার অভিজাত বিপণী বিতানের সাথে পরিচয় করানো। ফাঁকে তীব্র গরমে হাঁপিয়ে ওঠায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমলের শীতল পরশের ষ্পর্শ দেয়া।
পরদিন বিকাল ৩টার দিকে মালদাহর ট্রেন। তাই সকালেই হোটেল ছাড়লাম। ১ হাজার ৮০০ টাকায় ট্যাক্সি রিজার্ভ করে পুরো সময়টা কলকাতা ঘুরে দেখার আশায় নামলাম পথে। এই ভাড়ায় ঘুরতে পারবো ১শ’ কিলোমিটার। প্রথমে গেলাম বেলুর মঠ বা রামকৃষ্ণ মিশনে। সেখানে বামফ্রন্ট জমানায় একটি দৃষ্টিনন্দন মন্দির নির্মিত হয়েছে। সবকিছু দেখে মনে হলো এই মিশন সনাতন ধর্মের একটি গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় দিনমান। এরপর একে একে রাজারহাট, ইকো পার্ক, সায়েন্স সিটি, হাওড়া ব্রিজ, ইডেন গার্ডেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঝড়ের গতিতে ঘুরে দেখলাম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে সাড়ি সাড়ি দাঁড়িয়ে টমটম। পর্যটকদের নিয়ে পার্ক এলাকা ঘুরে দেখান এরা। বৃটিশ স্থাপত্যের এক অনুপম নির্দশন এই ভিক্টোরিয়া মেরোরিয়ালে রয়েছে নানান ঐতিহাসিক নিদর্শন। গেটের সামনে দুটো সিংহের ভাস্কর্য। কয়েকচন চীনা ও আমেরিকান নাগরিকের দেখা মিলল সেখানে।
আগের দিনে বস্তির দৈন্যতা মন থেকে মুছে ফেলতে রাজারহাট এলাকায় টুনু ভাই সুপারমলে নিয়ে গেলেন কিছু সময়ের জন্য। রাজারহাট এলাকার সুন্দর রাস্তা, পার্ক আর ফ্ল্যাটসহ চারপাশ থেকে মনে হলো হয়তো কোন উন্নত দেশে আছি। পাতাল রেলপথ, টানেল আর ফ্লাইওভারের কাজ চলছে জোর গতিতে। কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের চেহারাই বদলে দেয়া হয়েছে। সব মিলে কিছু এলাকা বাদে পুরো কলকাতা শহর ঝকঝকে তকতকে। বেশ সাজানো-গোছানো। স্থানে স্থানে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য বা বরেণ্য ব্যক্তিদের ছবি। ঢাকার মতো জ্যাম নেই,কারণ একদিকে উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আর মূল শহরে গার্মেন্টসের মতো শ্রমঘন কারখানা না থাকা। এখান থেকে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে বারবার মনে পড়েছে কথাটি।
শহর কলকাতায় ঘুরছি আর মনে হচ্ছে, ছোটবেলা থেকে অনেক প্রসিদ্ধ লেখকের লেখায় কলকাতা শহরের নানা বর্ণনা পড়ে শহরটি দেখার যে গোপন বাসনা জন্ম নিয়েছিল মনে, আজ তা পূর্ণ হলো। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকো আর শান্তি নিকেতন এবং নজরুলের আসানসোল না দেখার অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসতে হলো মালদহ শহরে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!