আব্দুল খালেক ফারুকের শব্দহীন প্রলাপ নিয়ে জরীফ উদ্দীনের আলোচনা

কাব্যগ্রন্থ-শব্দহীন প্রলাপ
লেখক: আব্দুল খালেক ফারুক
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি-২০২০
মূল্য: ১৫০ টাকা।
প্রকাশক: চমন প্রকাশ, ঢাকা।
‘শব্দহীন প্রলাপ’ আব্দুল খালেক ফারুকের প্রকাশিত ৪র্থ গ্রন্থ। গল্প, উপন্যাস, নাটক এর পর প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ “শব্দহীন প্রলাপ”। গ্রন্থটি পাঠের পর কবি আব্দুল খালেক ফারুককে নব্বই দশকের কবি বললেও ভুল হবে না। এই গ্রন্থটির বেশির ভাগ কবিতাই রচিত বিশ শতকের শেষের দিকে কবির ছাত্রজীবনে। যার ফলে কবিতাগুলোয় পাওয়া কবির সেই সময়ের অনুভূতি।
মানুষের সাহিত্য চর্চার সবচেয়ে প্রাচীন শাখাটি গান বা গীত, যার আধুনিক সংস্করণ কবিতা। চর্যাপদ থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্য পার হয়ে পুঁঁথির হাত ধরে পরবর্তী রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা পঞ্চপা-ব এর বলয় থেকে বেরিয়ে খুব কম সংখ্যক কবি স্বতন্ত্রভাবে কাব্যচর্চা করতে পেয়েছেন। বেশির ভাগই কবির লেখাজুড়ে পূর্বপুরুষের বলয়। অনুসরণ ও অনুকরণে ভরপুর। এই বলয় থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা অনেকটা লক্ষণীয় কবি আব্দুল খালেক ফারুকের ‘শব্দহীন প্রলাপ’এ।
মানুষের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, রাগ-অভিমান, প্রেম-ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতীক্ষা, জীবনের অনুভূতি নিয়েই কবিতাগুলো রচিত। আব্দুল খালেক ফারুকের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য প্রকৃতি প্রেম। তার লেখা কবিতায় চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে প্রকৃতির ছবি।
কবি আব্দুল খালেক ফারুক পদ্যের মাঝেই সৃষ্টি করেছেন এক চমৎকার সুর। যার মোহে একটি লাইন পড়লে তার পরের লাইনে মন ছুটে যায়। একটি কবিতা পড়া শেষ হলে অন্য কবিতা পড়ার তীর্ব আকাক্সক্ষা জন্মে।
কবিতাগুলোতে চমৎকার উপমা, রুপক আর প্রতীকের ব্যবহার-দুই দশক পরে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে আরো সুপাঠ্য। যা আব্দুল খালেক ফারুকের অগ্রগতি বলা যায়। বইটির প্রথম কবিতা ‘জীবন যাপন’ দীর্ঘ বিরতির পর এক অনবদ্য উপহার। সহজ কথা যে কত সহজেই বলা যায় তারই প্রমাণ।
‘ঠোঁটে ঝুলে থাকে গৌরবর্ণ হাসি/ চোখে চন্দ্রের ঝিলিমিলি রোশনাই/তোমার ঘর্মাক্ত সৌন্দর্য ভিজে দেয়
তৃষ্ণার্ত দু’চোখ।’
কিংবা-
‘তুমি আগের মতোই/ টিপ্পনীর দাঁড়ি-কমায় সাজাও/ অনুরাগের পঙতিমালা’
মানুষ বরাবরই নিজেকে ঢেকে রাখতে পছন্দ করে। কিংবা নিজেকে ভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে কৃষ্ণকায়, কুশ্রী। কেউ কেউ তাই আয়নাও দেখতে চায় না। চাঁদের পরিবর্তে ভালোবাসে অমাবস্যাকে। কবির ভাষায়
‘চন্দ্রভুক অমাবস্যার সাথে
কী করে যে সখ্য হয়-
আমি অসময়ে হয়ে যাই
জোসনাবিদ্বেষী বিরহী পুরুষ।’
কবি হৃদয় তার প্রেমিকার জন্য হয়ে যায় ব্যাকুল। তিনি মনে করেন এই বসন্তে প্রেমিকা না আসলে তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। তার একুশটি বসন্ত আমরণ অনশনে যাবে। স্বপ্নের পাখিরা মিছিলে কাঁপাবে রাজপথ। শুধু তাই নয়- মন যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। ‘বসন্ত বিষাদ’ কবিতা পাঠে নিজেই যেন সেই বিষাদের স্বাদ পাই। এই কবিতায় পাওয়া যায় কবি শামসুর রাহমানের ‘যদি তুমি না আসো’ কবিতার আকুতি।
‘শব্দহীন প্রলাপ’ এর কবিতাগুলো কবি নিবেদন করেছেন তার প্রেমিকার প্রতি। পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হয় কিংবা নিজেকেই প্রেমিক মনে হবে। প্রেমিকাকে বলতে ইচ্ছে করবে-
‘দোহাই তাকিও না অমন
আমি গলে যাই মমের মতন।’
অথবা
‘আমি এখন প্রেমিক পুরুষ/ অন্য মানুষ’
কবি ঘুরে বেড়ান একস্থান থেকে অন্যস্থানে পেশাগত দায়িত্বে। যেখানেই যান, যা কিছু দেখেন তা যেন গভীর দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেন। ‘চর মোনালিসা’ এমনি এক স্থান। কবি ক’জন তরুণসহ চর মোনালিসায় পা রাখেন গোধুলীবেলায়। চর মোনালিসার রূপ দেখে কবির মনে দোলা দেয় কবিতা আর গান। যখন ফিরে আসেন সেখান থেকে সমস্ত উচ্ছ্বাস যেন হারিয়ে যায়। কবির ভাষায়,
‘আমাদের পেছনে পড়ে থাকে
নব উদ্ভাসিত চর মোনালিসা।’
সেখানে চমৎকার রুপকে ফুটে তোলেন গোধূলীর রঙ।
‘ধরলার ইলিশরঙা জল ভেঙে/ শিরশিরে বয়ে চলা মাতাল হাওয়া’
কবি আব্দুল খালেক ফারুক ভালোবাসা না পেয়ে কখনো হয়ে যান হতাশ। যা গ্রন্থটিতে লক্ষনীয়। ‘ভালোবাসেনি কেউ’ কবিতায় অবলীলায় বলেন
‘পঁচিশ বসন্ত পেরিয়ে গেল
হৃদয় শুনল না কোনো অলির গুঞ্জন।’
তখন কবির জন্য জমা হয় আফসোস। কবির ভীরুতার জন্য মনে নেমে আসে বিষাদ
‘এই মেয়ে-তোমাকে আমি ভালোবাসি’………….
সাত কোটিবার রিহার্সাল দিলেও
সেই সংলাপ কখনো মঞ্চস্থ হতে পারেনি।’ এমন ভালোবাসার অনুভুতি আসলে সবার জীবনে আসে। সব কথা সব সময় বলা যায়না।
কবিতাগুলো পড়তে পড়তে যখন ভালোবাসার ঢেউ এ দোল খাই কিংবা দহনে পুড়ে যাই অথবা অভিমানে মুখ লুকিয়ে থাকি নয়তো কষ্টে সাঁতার কাটি তখন কবি আমাদের দেয় দুঃসংবাদ। ‘কবিতার দুঃসময়’ কবিতাটিতে। শূন্য দশকে লেখা কবিতাটি যেন চির যৌবনা। সমাজের বাস্তব কথাগুলো কবি সুচতুরভাবে নিপুণ হাতে তুলে ধরেছেন। প্রতিবাদ না করেও যেন প্রতিবাদী কণ্ঠ থেমে থাকেনি কবির।
‘আমাদের দরকার/ উপরির জন্য মুখিয়ে থাকা কেরানি/ টেন্ডাজীবী রাজনীতিক/ চর্বির ভারে ভারাক্রান্ত পুলিশ/ ক্যান্সারের ফেরিওয়ালা জনপ্রতিনিধি/ আর মক্কেল ফতুর করা উকিল।/ আমাদের দরকার/ বারো আউলিয়া খ্যাত বারো পাতি মাস্তান/ জন্মদিনের পোশাকে ট্রাফিক কন্টোল করা / বেহেড মাতাল নেতা।/ আমাদের দরকার/ পরনিন্দার ভাগাড়ে পূর্ণ বুদ্ধিজীবী,/ ডোনেশন বাগানো এনজিওকর্তা/আর কমিশনের জন্য লাইনে দাঁড়ানো/পরাধীন-পরাজিত যুবশক্তি।/ হায় কবিতা!………..’ সত্যিই কি দরকার এসবের?
এই একটি কবিতা বাদে প্রায় সবগুলোই প্রেমের কবিতা। শেষ কবিতায় দ্রোহের আওয়াজ শুনিয়ে হয়তো কবিতা আগামীতে কোন দ্রোহের কবিতায় সাজানো কাব্যগ্রন্থের আভাস দিয়েছেন। এই বইটি পড়ে সাহিত্যমোদী পাঠকদের ভালো লাগবে-এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!