নতুন নতুন কম্পানি খুলে প্রতারণার জাল বিস্তার

আব্দুল খালেক ফারুক:
কুড়িগ্রামে ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া আল হামীম কম্পানির সাবেক কর্মকর্তারা পৃথক পৃথক কম্পানি খুলে এখনও প্রতারণা চালু রেখেছেন। সাবেক জেলা কর্মকর্তা মাওলানা হাফিজুর রহমান তার ৩ সহযোগীকে নিয়ে খুলেছেন কুড়িগ্রাম ‘বিকিরণ কমার্স এন্ড বিসনেস সেন্টার’। দ্বিগুণ লাভের ফাঁদে ফেলে প্রায় ২ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে এখন ঘুরাচ্ছেন আমানতকারীদের। সাবেক জেলা কর্মকর্তা মাওলানা আনিছুর রহমান উলিপুরের পাঁচপীর বাজারে ‘আল হামীম কমার্স এন্ড বিসনেজ লিমিটেড’ নামে আর একটি কম্পানি খুলে প্রায় আড়াই কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছেন।
উল্লেখ্য, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার ৩ হাজার গ্রাহকের ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা নিয়ে হাওয়া হয়েছে আল হামীম পাবলিক নিমিটেডের এমডি এনামুল কবীর কহিনুর ও তার সহযোগীরা। এই কম্পানি কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় চারটি ক্যাটাগরিতে সদস্য সংগ্রহ করে। কাগজপত্রে ইসলামি শরীয়া মোতাবেক ব্যবসা পরিচালনা করার কথা বলা হলেও দ্বিগুণ লাভের কথা বলে প্রলুব্ধ করা হয় সাধারণ মানুষকে।

বিকিরণের ব্যবসা
কুড়িগ্রাম গণপূর্ত বিভাগের সামনে ‘বিকিরণ কমার্স এন্ড বিসনেস সেন্টার’ নামে কম্পানির একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। ভেতরে দু’একজন স্টাফও খাতাপত্র নিয়ে বসে থাকেন। আল হামীমের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাওলানা হাফিজুর রহমান চেয়ারম্যান ও সাবেক জেলা কর্মকর্তা আদম আলী ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তারা পাওনাদারের চাপে বসেননা অফিসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পণ্য বিক্রির পাশাপাশি লভ্যাংশ দেয়ার লোভনীয় অফার দিয়ে বিভিন্ন পেশার কয়েকশ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে এই প্রতিষ্ঠান। মাঠে পণ্য বিক্রি বাবদ বকেয়া ৩০ লাখের বেশি নেই। বাকী টাকার কোন হদিস নেই। কয়েক মাস ধরে আমানতকারীদেরও মুনাফা দেয়া বন্ধ।
বিকিরণের সাবেক মাঠ কর্মী মাহফুজার অভিযোগ করেন, ২০১৭ সালে তিনি বিকিরণে যোগদানের সময় নগদ ১৫ হাজার টাকা ও ব্যাংকের দু’টি চেকের পাতা জমা দেন। এক সময় বুঝতে পারেন তারা অবৈধ ব্যবসায় সহযোগিতা করছেন। তিনিসহ ৫ জন মাঠকর্মী চাকুরি ছেড়ে দেন। এরপরই তাদের উপর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন হাফিজুর ও আদমের বিকরণ। তার বিরুদ্ধে চেক ডিজওনারের দুটি মামলা দেয়া হয়। যার একটির বাদী ভাড়াটে এক ব্যক্তি। যাকে তিনি কখনও চিনতেন না। একই অবস্থা চাকুরি ছেড়ে দেয়া মাঠকর্মী ইউনুছ, আনোয়ার, ইলিয়াস, মাহফুজ ও আব্দুর রশিদের।
২০১৯ সালে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ দিলে কুড়িগ্রামের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ময়নুল হক বিষয়টি তদন্ত করেন। তিনি ফাঁকা চেক গ্রহন ও তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সত্য গোপন করার অভিযোগ করেন তার দেয়া প্রতিবেদনে।
আমানতকারী রাজারহাটের বৈদ্যেরবাজারের শহিদুল ইসলাম জানান, তার নিজের দেড় লাখ টাকাসহ ভাইবোন মিলে ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা মাসিক লভ্যাংশ দেয়ার শর্তে বিনিয়োগ করেছেন বিকিরণে। চার মাস ধরে কোন লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছেনা। একই অবস্থা সদর উপজেলার ধরলা ব্রিজের পূর্বপারের ডেকোরেটর ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনের। তিনি ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে কোন লাভ পাচ্ছেননা। আসল টাকাও পাবেন কীনা অনিশ্চিত।
বিকিরণের সাবেক ম্যানেজার নাসির উদ্দিন স্বীকার করেন, ‘অবৈধভাবে সাধারণ মানুষের কাছে আমানত সংগ্রহ আর কর্মীদের ফাঁকা চেক নিয়ে এখন চেক ডিজওনারের মামলা দেয়া হয়েছে। তাদের ন্যায্য বেতনও দেয়নি। যা চরম অন্যায়। আমার কাছেও দুটি চেকে পাতা নেয়া হয়েছে। কিন্তু ফেরৎ দেয়া হয়নি।’
এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আদম আলী বলেন, ‘কারো কাছ থেকে কোন চেক নেয়া হয়নি। মামলা হয়েছে ব্যক্তিগত লেনদেনের কারণে।’ এছাড়া করোনার কারণে ব্যবসায় মন্দার কারনে মুনাফা দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানান তিনি।

গৃহসজ্জার গল্প
২০১৭ সালের মে মাসে ‘গৃহসজ্জা ট্রেডার্স’ এ যোগ দেন বুড়াবুড়ির রিয়াজুল ইসলাম। ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। হাফিজুর রহমান ও তার ভাই সাদেকুর রহমান এর মালিকানাধীন গৃহসজ্জা। দু’জনেই তার ভগ্নিপতি। প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ছিল সদর উপজেলার যাত্রাপুর বাজারে। গত বছর চাকুরি ছেড়ে দেয়ার পর দুর্বৃত্তদের সহায়তায় তার কাছ থেকে হাফিজুর ফাঁকা স্টামে স্বাক্ষর নেন। পরে ১০ লাখ টাকা দাবী করেন। বাধ্য হয়ে ভগ্নিপতিদ্বয়ের বিরুদ্ধে স্টাম উদ্ধারের জন্য আদালতে মামলা করেছেন তিনি। এ অবস্থায় গত বছর সাদেকুর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর পরদিন সকালে দাফন হবে মর্মে মাইকিং করা হয়। কিন্তু আমানতকারীদের ভিড় এড়াতে রাতেই তাড়াহুরা করে কবর দেয়া হয়। ঢাকাতেও আমানতকারীদের কয়েক লাখ টাকা পাওনা ছিলো সাদেকুরের কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গৃহসজ্জায় পণ্য বিক্রির পাশাপাশি প্রায় ৫০ লাখ টাকা আমানত সংগ্রহ করা হয়। এখন অফিস বন্ধ করে উধাও উদ্যোক্তারা। গৃহসজ্জার আমানতকারী উলিপুরের রামেশ্বর শর্মা গ্রামের শামসুল আলম ও পানদেব গ্রামের ফারুক মিয়া অভিযোগ করেন, তারা ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে বিনিয়োগ করে ৫ বছর মেয়াদপূর্তির দু’বছর পরেও আসল টাকাও পাচ্ছেননা। এ ব্যাপারে মাওলানা হাফিজুর রহমানের বক্তব্য জানার জন্য ফোনে একাধিক বার যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। কুড়িগ্রাম শহরের ডাকবাংলা পাড়ায় তার ভাড়া বাসায় দু’দফা যোগাযোগ করেও বাসায় কাউকে পাওয়া যায়নি।

নতুন আল হামীমের ফাঁদ
আল হামীম কম্পানির কিছু জমি নিজ জিম্মায় নেয়া ও অভিন্ন স্টাইলে আমানত সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করার মতলবে আল হামীমের সাবেক জেলা সভাপতি মাওলানা আনিছুর রহমান খুলেছেন ‘আল হামীম কমার্স এন্ড বিসনেস লিমিটেড, নামে আর একটি কম্পানি। নিজেকে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পরিচয়দানকারী মাওলানা আনিছুরের সহযোগী পরিচালকদের অনেকেই একটি ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
উলিপুর উপজেলার পাঁচপীর বাজারে নতুন আল হামীমের অফিস। আল হামীম কম্পানির নামে উলিপুর ও মাঝবিল বাজারে কেনা ৫০ শতক জমি আনিছুর তাঁর নতুন কম্পানির জিম্মায় নিয়েছেন।
বিনিয়োগ করার শর্তে প্রায় তিন হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ইতোমধ্যে ৩ কোটি টাকাও সংগ্রহ করেছেন। প্রকল্প হিসেবে পোষ্টার ও অন্যান্য প্রচারপত্রে বিনিয়োগ, আবাসন, মৎস্য ও ডেইরি খামার, নার্সারী ও বনায়ন. হেলথ এন্টারপ্রাইজসহ ১৩টি চলমান প্রকল্প দেখানো হলেও বাস্তবে দুই একটি ছাড়া অন্যগুলির অস্তিত্ব নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমানতকারীদের টাকায় আনিছুর গত তিন বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। তার বাবা মুসা মিয়া মাঝবিল বাজারের একজন নৈশপ্রহরী ছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রাইভেট কার হাঁকিয়ে বেড়ান। কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন আলিশান বাড়ি। এ ব্যাপারে আনিছুর জানান, তিনি কম্পানি থেকে প্রাপ্ত বেতনের টাকা থেকে বাড়ি নির্মাণ ও গাড়ি ক্রয় করেছেন।
এই তিনটি কম্পানি ছাড়াও কুড়িগ্রাম সদরের মাওলানা মো: মোকছেদ আলী সেফ বিসনেজ লিমিটেড ও উলিপুরের মাওলানা আছয়াদুর রহমান আপেল আত তাহমিম নামে কম্পানি খুলে কয়েক লাখ টাকা আমানত সংগ্রহ করে বর্তমানে আসল বা মুনাফঅ কোনটিই না দিয়ে গ্রাহকদের ঘুরাচ্ছেন।

তদন্তে অগ্রগতি নেই
আল হামীম কম্পানির প্রতারণার শিকার শত শত আমানতকারী ও মাঠকর্মী গত ৩ জানুয়ারি মানববন্ধন ও সমাবেশ করে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। উলিপুর থানায় কম্পানির কর্মকতাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার আসামীরা হলেন, আল হামীমের সাবেক জেলা কর্মকর্তা মাওলানা আনিছুর রহমান, মাওলানা রেজাউল করিম ও মাওলানা আছয়াদুর রহমান আপেল। অভিযোগে বলা হয়, মেয়াদ শেষে বিভিন্ন স্কীমে সদস্যদের জমাকৃত টাকার লভ্যাংশ না দিয়ে কম্পানির কর্মকর্তারা তা প্রতারণামুলকভাবে আত্মসাত করেছেন। এই তিন আসামী ইতোমধ্যে কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে অবাধে ঘুরছেন।
গত ৬ জানুয়ারি জেলা প্রশাসন থেকে এই প্রতারণার ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। তাদেরকে ঘটনা তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। পরে সময়সীমা আরো এক মাস বাড়িয়ে নেয়া হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ পরিচালক ও জেলা সমবায় অফিসার। কমিটি এরই মধ্যে অভিযোগকারী কয়েকজন মাঠকর্মী ও সাধারণ মানুষের বক্তব্য শুনেছে। এ ব্যাপারে কমিটির অন্যতম সদস্য জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আলী রেজা বলেন, ‘বিষয়টি অনেক জটিল তাই তদন্ত করতে সময় লাগছে।’ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলে পরবর্তি ব্যস্থা নেয়া হবে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!