কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ে ও শিশু শ্রমে ঝরে গেছে অনেক শিক্ষার্থী

আব্দুল খালেক ফারুক:
কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে করোনাকালে ব্যাপকহারে বাল্য বিয়ে ও শিশুশ্রমের কারণে ঝরে গেছে অনেক শিক্ষার্থী। গোপনে দেয়া বাল্য বিয়ে কারণে স্কুল ও মাদ্রাসার কোন কোন ক্লাশে ছাত্রী শূন্য হবার উপক্রম হয়েছে। পাশাপাশি দারিদ্রতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হওয়ায় ছেড়ে দিয়েছেন বিদ্যালয়ের পাঠ। ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক বলে স্বীকার করেছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা। করোনাকালীন দীর্ঘ ছুটির পর কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল ও নদ—নদী বেষ্টিতে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ব্যাপকহারে ঝরে পড়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন শিক্ষক ও কর্মকতার্রা। সরেজমিন গত ৫ দিন কয়েকটি বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করে এমন চিত্র দেখা গেছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা এমদাদীয়া দাখিল মাদ্রাসায় ৬৩জন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত আছেন। দাখিল পরীক্ষায় ৭ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তারা পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য ফরম পূরণ করেননি। দাখিল মানবিক শাখায় ১১ ছাত্রীর ৯ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। এছাড়া দশম শ্রেণির ছাত্রী রুপসা খাতুন জানান, এই ক্লাশের মুক্তা, রেশমা, রাশেদাসহ অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ঢাকায় গার্মেন্টস, রাজমিস্ত্রি সহ নানা কাজে যুক্ত হয়েছেন জসিম, আব্দুল আলী, আল আমিনসহ অনেকেই।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবু বক্কর সিদ্দিক খন্দকার জানান, চরাঞ্চলে কম যৌতুক প্রথা ও নিরাপত্তার অভাব বোধ করে দরিদ্র ও অসচেতন অভিভাবকরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেন। আর ছেলেরা যান কাজ করতে। তবে বিয়ের পরেও যাতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকে সেজন্য চেষ্টা করা হয়।
সারডোব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৩৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত আছেন ৬৭ জন। স্কুল সুত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ৭৯ জন ছাত্রীর মধ্যে দরিদ্র অভিভাবকরা গোপনে ১৮ জন ছাত্রীর বিয়ে দিয়েছেন। এদের মধ্যে দশম শ্রেণির ৩ জন, নবম শ্রেণির ৮জন, অষ্টম শ্রেণির ৪ জন, সপ্তম শ্রেণির ২ জন, ৬ষ্ঠ শ্রেণির একজন ছাত্রীর বাল্য বিয়ে হয়েছে এই সময়ে। এর মধ্যে নবম শ্রেণির ৯ জনের মধ্যে ৮ জনের বিয়ে হয়েছে। ৬জন রেজিস্ট্রেশনও করেননি। ফলে তারা স্কুলে আসা ছেড়ে দিয়েছেন। বাল্য বিয়ের পাশপাশি এই স্কুল থেকে বেশ ছাত্র কাজ করতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে গেছেন।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফজলার রহমান জানান, বাল্য বিয়ের ব্যাপারে শিক্ষকদের টিম করে দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর কাজের কারণে বাইরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনতে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
করোনাকালে হলোখানা নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৫ জন ও কাগজীপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষকরা।
ফুলবাড়ী উপজেলার রাঙামাটি সরদার পাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নাসিমা খাতুন জানান, এই স্কুলের দশম শ্রেণির ১২ ছাত্রীর মধ্যে ৬ জনের, নবম শ্রেণির ২২ ছাত্রীর মধ্যে ১২ জনের, অষ্টম শ্রেণির ৪ ছাত্রীর মধ্যে ৩ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, শুধু বাল্য বিয়ে নয়, দারিদ্রতার কারণে গার্মেন্টসসহ বিভিন্নক্ষেত্রে কাজের জন্য ছাত্র—ছাত্রীরা চলে গেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। তাই বর্তমানে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি ৬০ ভাগের নিচে। বাল্যবিয়ের শিকার ছাত্রীদের প্রায় সবাই অনুপস্থিত রয়েছেন।
জেলা শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা গেছে, চরাঞ্চল অধ্যুষিত রৌমারী উপজেলার চারটি বালিকা বিদ্যালয়ে এ বছর ১১৮ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। শতাধিক ছাত্রী গেছেন গার্মেন্টস এ কাজ করতে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম জানিয়েছেন, কয়েকটি উপজেলায় ঝরে পড়া নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা উদ্বেগজনক। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে পরবতীর্ করণীয় ঠিক করা হবে।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!