‘মাইন পুঁতে পাক আর্মির গাড়ি উড়িয়ে দেই’

আব্দুল খালেক ফারুক
হোসায়েন আলীর (হোসেন) বয়স তখন ২২। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার শপথ নিয়ে যুদ্ধ অংশগ্রহনের জন্য ঘর ছাড়েন ২৮ মার্চ। সঙ্গে ছিলেন গ্রামের আরো চার যুবক। ভুরুঙ্গামারী ও সাহেবগঞ্জ ক্যাম্পে রিপোর্ট করার পর প্রশিক্ষণের জন্য তাদের দলটিকে পাঠানো হয় ভারতের দার্জিলিংয়ের ভুটান সীমান্তের কাছে মুজিব ক্যাম্পে। সেখানে একটানা ২৮ দিন প্রশিক্ষণ নেন। এরপর কোম্পানি কমান্ডার আকরাম হোসেনের নেতৃত্বে তাকে পাঠানো হয় কুড়িগ্রামের সীমান্তবর্তী সোনাহাট ক্যাম্পে। প্রথম কয়েকদির রেকি করার পর পাঠানো হয় অপারেশনে।
প্রথম অপারেশনের স্মৃতি এখনও জ¦লজ¦লে তাঁর মনে। মৃত্যুর মুখ থেকে অনেকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে ওঠার স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেন না তিনি। হোসায়েন আলী সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ভারতীয় মেজরের নির্দেশে কোম্পানীর সবচেয়ে চৌকস ও সাহসী যোদ্ধাদের বাছাই করা হয়। সোনাহাট ব্রিজের পশ্চিমপারে বাংকার খুঁড়ে ডিফেন্স নেই। পাক বাহিনীর আসার পথে এন্টি পারসোনাল মাইন পুঁতে রাখি। কমান্ডারের নির্দেশে এক্সপ্লোসিভ দিয়ে কাটিং চার্জ করে সোনাহাট ব্রিজের একটি গার্ডার ধবংস করি। এ বিষয়ে আমার বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকায় আমাকেসহ কয়েকজনকে পাঠানো হয় এই কাজে। পরদিন সকাল ১১টার দিকে পাক আর্মির একটি গাড়িবহন ওই এলাকায় আসার সাথে সাথে একটি গাড়ি উড়ে যায়। নিহত হন বেশ কয়েকজন পাক আর্মি। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় তিন ঘন্টা গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে আমাদের গুলি ফুরিয়ে যায়। আমার বাংকারে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আজিজার ছিলো। আমরা আত্মরক্ষার জন্য দুধকুমার নদে ঝাঁপ দেই। পার হবার আগেই আমাকে বাংকারে মর্টার চার্জ করা হয়। ব্রিজের উপর থেকে গুলি করে পাক আর্মি। গুলি খেয়ে আজিজার ডুবে যায়। আমিও গুলিবিদ্ধ হই। কচুরিপানা আর কলাগাছের আড়াল হয়ে ভাটির দিকে যেতে থাকি। সারাদিন ও সারারাত নদীতে ভেসে থাকার পর ভোরের দিকে চরের বালুতে পা ঠেকে। এরপর স্থানীয় এক চিকিৎসক একটি গুলি বের করে। অবস্থা অবনতি হলে গরুর গাড়িতে আমাকে ভারতের হাসপাতালে পাঠানো হয়। আর পুঁটিমারীর চরে আজিজারের লাশ দাফন করা হয় এক বিধবার জমিতে।’
৯ মাস রণাঙ্গণে অবস্থান করার সময়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন হোসায়েন। ঝুঁকি আর সাহসিকতার জন্য তাকে ‘পাগলা হোসেন’ বলে ডাকতেন সবাই। বুধবার দুপুরে তার রাজারহাট উপজেলার উমর পান্তাবাড়ি গ্রামে স্মৃতিচারণ করেন এই বীরসেনা। এ সময় তিনি বলেন ‘ভুরুঙ্গামারীর পাটেশ^রী যুদ্ধে আমাদের কোম্পানি পাক বাহিনীর বেড়িকেটের মধ্যে পড়ি। আমাদের বাঁচার কোন উপায় ছিলোনা। আমরা অনেক কৌশল অবলম্বন করে কোনমতে সটকে পড়ি। অবশ্য এই যুদ্ধে আমাদেরকে বেশ কয়েকজন সহকর্মী শহিদ হন। এরপর আমাদেরকে পাঠানো হয় ভুরুঙ্গামারীর বাউশমারী এলাকায়। স্থানীয় চেয়ারম্যান নিজের বাতানের একটি গরু জবাই করে রান্না শুরু করেন। হঠাৎ পাকিবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। আমরাও পাল্টা জবাব দেই। তিনদিন পর্যন্ত এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়। আমাদেরকে কভারিং দেয়ার জন্য মুক্তিবাহিনীর আরো একটি কোম্পানী পাঠানো হয়। ২০/৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ সেই যুদ্ধে উভয়পক্ষে বেশ কিছু লোক হতাহত হয়। এক পর্যায়ে পাক বাহিনী পিছু হটে গেলে যুদ্ধ থেমে যায়। সেখান থেকে আমাদেরকে ভুরুঙ্গামারীর মিলনী স্কুলে পাক বাহিনীর প্রধান ক্যাম্পটি আক্রমণের জন্য পাঠানো হয়। এ সময় খাবারের কোন ব্যবস্থা না থাকায় তেতুল পাতা, নারকেল আর জাম্ভুরা খেয়ে কোনমতে দিন কাটিয়েছি।’
মিলনী স্কুলে পাক বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ৪১ জন ধর্ষিত নারী উদ্ধারের কষ্টকর স্মৃতিচারণ করেন হোসায়েন আলী বলেন, ‘আমরা ইনফরমারের কাছে তথ্য নিয়ে পাকবাহিনী যখন নিরস্ত ছিলো, তখনই আক্রমন চালাই। পাকবাহিনীর বেশ কিছু সৈন্য মারা যান। অনেকেই পালিয়ে যান। বাংকারে সাচিং করার সময় ৪১ জন জীবিত বাঙালি নারীকে আমরা উদ্ধার করি। যারা প্রায় বস্ত্রহীন অবস্থায় ছিলো। এদের বেশীরভাগই গর্ভবতি ছিলো। কয়েকজন নারীর মরদেহ পাওয়া যায়। একজন সামনেই মারা যান। বাংকারে সারি সারি পাক আর্মির মৃতদেহ পড়ে ছিলো।’
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে হোসায়েন আলীসহ কয়েকজনকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য দার্জিলিংয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় নেপালে। সেখানে ১৫ দিন প্রশিক্ষণের সময় হাতির আক্রমণে ১৫/২০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে হাতির দল। মারা যান ৩ জন প্রশিক্ষকও। পরে গুলি করে মারা হয় কয়েকটি হাতিকে। পরে দার্জিলিংয়ে ফিরে আসার পর শেখ কামাল ও শেখ জামাল যান ওই ক্যাম্পে। এরপর সাহেবগঞ্জ হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয় তাকে। সেখান থেকে আগষ্ট মাসে বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ির ফেরিটি ধবংসের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকেসহ কয়েকজন যোদ্ধাকে। এই স্মৃতিচারণ করে হোসায়েন আলী বলেন, ‘আমরা ফুলছড়ি ঘাটের ৩ মাইল আগে থেকে নদীতে গা ভাসিয়ে দেই। ফেরি আসার সাথে সাথে দূর থেকে ৪টি এন্টি ট্যাংক মাইন দিয়ে ফেরিটি ধবংস করে দেই। ওখানে বেশ কিছু পাক আর্মি হতাহত হয়। আমাদের দিকে বোমা ছুঁড়ে মারে। এতে সহকর্মী মহসিন নিহত হন।
তিনি আরো বলেন, আমরা পাক আর্মি বহন করার ট্রেন ধবংস করার সিদ্ধান্ত নেই। ২৭ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ট্রেন চলে আসার সাথে সাথে প্রচন্ড শব্দে ব্লাষ্ট হয় মাইন। পরে ট্রেনে থাকা পাকসেনারা গুলি করতে থাকে। দু’পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। পরিকল্পনামতো কাজ না হওয়ায় অনেকটা সমস্যায় পড়ে যাই। তা সত্বেও দিনভর যুদ্ধ চলার পর আমরা নিরাপদে চলে যেতে পারি। যুদ্ধে ৭ জন রাজাকার নিহত এবং আহত হন সহকর্মী মনদ্দিসহ আরো ২ জন। নিহত পাকসেনাদের ওরা নিয়ে যায়।’
কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত হবার আগেই একজন রাজাকারকে হত্যা করেন তিনি। এক সময় ওই রাজাকারের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। তাকে বাপ ডাকলেও মাফ করেনিনি। পরে নাকে ঘুষি দিয়ে রাজাকারের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। এতো কিছু পর হোসায়েন আলীর মনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ার কষ্ট পোড়ায়। আবেদন করেও সাড়া পাচ্ছেন না তিনি।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!