বিলুপ্তির পথে নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ি

আমিনুল ইসলাম, ফুলবাড়ী:
ইতিহাসের স্বাক্ষী ফুলবাড়ির নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ী এখন শুধুই ¯মৃতি। অযত্ন, অবহেলায় প্রাচীন কীর্তি ও প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন এ জমিদার বাড়ির দ্বিতল ভবন, বাসগৃহ,অতিথি ও নাট্যশালা ,রাজদরবার (কাছারী), ট্রেজারি, প্রাচীর, পুকুর,শালবন, ঘোড়াশাল, বাগান,দোলমঞ্চ, হাওয়াখানা, শিব,দূর্গা,কালি,ও বিষ্ণু মন্দির ,চন্ডীমন্ডপ, বকুল ও চাপাগাছ সব কিছুই বিলুপ্তির পথে। এলাকার কিছু সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি জমিদারবাড়ি এবং এর মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছে। এর সীমানার ভেতরে অবৈধভাবে ঘর-বাড়ি করে বসবাস করছে।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ির অবস্থান। কথিত আছে, পঞ্চদশ শতকের কোনো এক সময় সম্রাট আকবরের আমলে পরাজিত ও রাজ্যচূত গৌড় বংশীয় কোনো ক্ষত্রিয় ব্রা‏ন যশোহর থেকে পালিয়ে এসে বসবাস শুরু করেন এখানে । পরে তিনি রঘু প্রসাদ বকসী নামে পরিচিত হন এবং ভারতের কুচবিহার মহারাজা শ্রী জগ¦ৎ দীপেন্দ্র ভূপ বাহাদুরের ঠাকুর ঘরের পুরোহিত হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন। তার পুত্র শিব প্রসাদ বকসী মেধাবী ছাত্র ছিলেন। শিব প্রসাদ জেংকিং স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাস করেন। মহারাজা তাকে কুচবিহারের তুফানগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক নিযুক্ত করেন। সে সুবাদে তিনি মহারাজার আনুকূল্যে তিনি জমিদারি লাভ করেন। এ হিসেবে শিব প্রসাদ বকসীই নাওডাঙ্গায় তার পৈত্রিক ভিটায় জমিদারির গোড়াপত্তন করেন। তার মৃত্যর পর একমাত্র পুত্র অম্বিকা প্রসাদ বকসী জমিদার হন। এ সময় তিনি জমিদারির বিস্তৃতি ঘটান। তার মৃ‏ত্যুর পর দুই পুত্র প্রমোদরনঞ্জন বকসী ও অন্নদা প্রসাদ বকসী জমিদারি লাভ করেন। অন্নদা প্রসাদ বকসী ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি সব সময় মদের আসরে ডুবে থাকতেন। তাছাড়াও তিনি প্রজা নিপীড়ক ছিলেন। কিন্তু তার বড়ভাই প্রমোদরঞ্জন বকসী ছিলেন ধার্র্মিক, সহানুভূতিশীল এবং প্রজাপালক। তিনি জমিদারিকে সুসংহত করে নানা জনহিতকর কাজ করেন। তার বদান্যতায় ১৯১৯ইং সালে তিনি ‘নাওডাঙ্গা মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়‘ প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে কলেজে উন্নীত হয়েছে। জমিদারির শেষ দিকে তিনি কোলকাতায় তার নিবাস গড়েন। তার মৃত্যুর পর তিন পুত্র বিরেশ্বর, বিশ্বেশর এবং বিপুলেশ্বর বকসী জমিদারি লাভ করেন। এদের মধ্যে বিরেশ্বর ছিলেন কোলকাতা হাইকোর্টের বিচারক। তিনি কোলকাতার চুচুড়ায় বসবাস করতেন। সে সময় থেকে তারা কোলকাতায় থেকে নায়েব, গোমস্তা দিয়ে জমিদারি চালান ।
বাংলা ১৩৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইন পাস হলে জমিদারি দেখা-শুনার জন্য পাওয়ার অফ এটর্নী স্থানীয় হরিবোলা রায়, ডাঃ কৃষ্ণ কেশর দেব, নলিনী মোহন দে প্রমুখকে দেন।কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে বিপুল পরিমান খাজনা বাকি রাখার দাবীতে রাজস্ব বিভাগ প্রায় ৫শ বিঘা জমি নিলামে ওঠায়। উভয় পক্ষে মামলা-মোকদ্দমা চলে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব জমির কাগজ পত্র নষ্ট হলে নিলাম ক্রেতারা একতরফা জয়লাভ করে। ফলে এসব জমি বেহাত হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও জমিদার বাড়িসহ রাখাইন সম্প্রদায়ের (জমিদারের পাইক, পেয়াদা ,বরকন্দাজ) জন্য প্রায় ৪০/৫০ বিঘা জমি বিভিন্ন মন্দিরের মূল্যবান মূর্তি ,শালবন ,পুকুর এবং গাছ-গাছরা থেকে যায় । রাধাকৃষ্ণ যুগল মুর্তি এবং শিব লিঙ্গটি মন্দিরের সেবাইতের কাছে জমা আছে। জমিদারবাড়ির ইট ও মূল্যবান সামগ্রী চুরি হয়ে যাচ্ছে। ৭৫ খানা মূল্যবান আইন বই ইতোমধ্যে চুরি হয়ে গেছে । জমিদার বাড়িটি সরকারের প্রতœতত্ব বিভাগ গ্রহন করে সংরক্ষণ করে তবে এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!