মক্কা-মদিনায় ২৪ ঘণ্টা কারফিউ

মুহাম্মদ নূরুল হুদা, সৌদি আরব থেকেঃ

করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ ছোবলে সারা বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল যেন বেড়েই চলছে। করোনার ভয়াল রুপ দেখে গোটা বিশ্ববাসী আজ আতঙ্কিত। করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে সমগ্র পৃথিবীর স্বনামধন্য ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা আজ দিশেহারা, ব্যস্ত পৃথিবী আজ স্থবির।

ইউরোপ, আমেরিকার পর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। সৌদি আরবের ৩৪.৮১ মিলিয়ন জনগণের মধ্যে গত এক মাসে এখন পর্যন্ত ২০৩৯ জন মানুষের মাঝে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত করেছে সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সৌদি আরবে সর্বপ্রথম কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয় ২ মার্চ, ২০২০ -এ। আক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন একজন সৌদি নাগরিক, যিনি ইরান থেকে বাহরাইন হয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করেছিলেন।  

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়েছে ২০৩৯ জন, এর মধ্যে ৩ জন বাংলাদেশী ও ১ জন আফগানিস্তানের নাগরিকসহ মোট ২৫ জন, অর্থাৎ ১.২২ শতাংশ লোক মৃত্যুবরন করেছে যা বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় নগণ্য। যেখানে বর্তমান বিশ্বে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃতের হার ১৮ শতাংশ, সে তুলনায় সৌদি আরবে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার অনেক কম।

  সৌদি আরবে এই হার কম থাকার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌদি আরবের স্বাস্থ্য নির্বাহী বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিরোধক ঔষধ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ এজুদ্দিন ওকমি জানান, করোনা শনাক্তকরণে সৌদি আরবে পর্যাপ্ত ল্যাব টেস্ট করানো হচ্ছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া প্রতিরোধমূলক কর্মপন্থা যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।

  সংক্রমণের শুরু থেকেই কোভিড-১৯ এর বিস্তার সীমাবদ্ধ করতে সৌদি সরকার শুরু থেকেই অনেক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সেগুলো জনগণ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে করোনা প্রতিরোধের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ফলে করোনা প্রতিরোধী কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সৌদি সরকার সফলতার পথেই হাঁটছে।

 যদিও সৌদি আরবে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত করা হয় ২ মার্চ -এ, তবুও ৪ মার্চ থেকেই সৌদি সরকার বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে। ৪ তারিখ থেকে পবিত্র ওমরাহ সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করা হয় এবং সৌদি আরবের অন্যতম জনবহুল নগরী মক্কা এবং মদিনায় মানুষের প্রবেশ সীমিত করে দেয় সরকার। ৭ মার্চ থেকে সকল ধরনের ইনডোর এবং আউটডোর গেম বন্ধ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে ৮ মার্চ থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়, ১৪ মার্চ থেকে সকল ধরনের বিনোদন পার্কে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়, ১৫ মার্চ থেকে ফার্মেসী এবং সুপারমার্কেট ছাড়া সকল ধরনের দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয় এবং একই দিন থেকে সকল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়, ১৯ মার্চ থেকে কা’বা শরীফ এবং মসজিদে নববী ব্যতীত অন্য সকল মসজিদে জুম্মার নামাজসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় স্থগিত করা হয় এবং ২০ মার্চ থেকে কা’বা শরীফ ও মসজিদে নববীতে সাধারন মানুষের জন্য নামাজ আদায় স্থগিত করা হয়।

  এরপর ২০ মার্চ থেকে অভ্যন্তরীণ সকল ফ্লাইট, বাস, ট্যাক্সি এবং ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। কার্যত ২০ মার্চ থেকে পুরো সৌদি আরব লকডাউন হয়ে পরে। পরবর্তীতে অবস্থার অবনতি হলে সৌদি সরকার ২৮ মার্চ থেকে পুরো সৌদি আরবে কারফিউ জারি করে সন্ধ্যা ৭টা হতে সকাল ৬টা পর্যন্ত। এরপর কিছু এলাকায় সংক্রমণ বাড়তে থাকলে সেই এলাকাগুলোতে কারফিউ এর সময় পরিবর্তন করে বিকাল ৩ টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত করা হয়।

 সর্বশেষে অবস্থার আরো অবনতি হলে ৩ এপ্রিল থেকে মক্কা এবং মদিনায় ২৪ ঘন্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। তবে এসময় চিকিৎসা সেবা ও খাবার সংগ্রহ করার জন্য এই নগরের বাসিন্দারা ভোর ৬ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন। এই দুই নগরীর খাবার দোকান , হসপিটাল ও ফার্মেসী ছাড়া অন্যান্য সকল ধরনের দোকানপাট বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। মুদি সামগ্রি এবং খাবারের জন্য যতটা সম্ভব হোম ডেলিভারি সার্ভিস ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।

সৌদি আরবের এসকল প্রতিরোধমূলক জোরালো পদক্ষেপের কারণে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের বিস্তার তুলনামূলকভাবে সীমিত আছে এবং এখন পর্যন্ত মোট ৩৫১ জন করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়েছেন। তবে কারফিউ পরিস্থিতিতেও এখানকার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অনলাইনে Distant Learning পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং সীমিত আকারে অনলাইন ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে।

সৌদি আরবের চিকিৎসা সেবা যথেষ্ট উন্নত ও মানসম্মত এবং হটলাইন সেবাও যথেষ্ট সক্রিয়। পরিশেষে সৌদি আরবের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এবং আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার আলোকে যে বার্তাটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই সেটা হলো- আমাদের দেশে যেহেতু উন্নত দেশগুলোর মতো পর্যাপ্ত টেস্ট করানোর মতো সক্ষমতা নেই, তাই পুরোপুরি লকডাউনই হতে পারে সবচাইতে কার্যকর পন্থা।

 তবে যাদের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেবে তাদেরকে দ্রুত আইসোলেশনে রেখে পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি জন্সচেতনতা  বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে হবে; তিনি চাইলেই কেবলমাত্র আমরা এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে পারি।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা, সৌদি আরব।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!