৫৯৫ কোটি টাকার ধরলা প্রকল্পে বরাদ্দ মাত্র ৫ কোটি টাকা

আব্দুল খালেক ফারুক:
বর্ষা আসছে। বাড়ছে ভাঙনের শঙ্কা। গত বছরের ভাঙা বাঁধ মেরামত হয়নি। তাই ধরলা পারের সারডোব গ্রামের বাসিন্দা আফতার আলীর চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। বাঁধ মেরামত ও রক্ষার কাজ না হলে তার ভিটেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ধরলার গর্ভে। আবারও দেখতে হবে গত বছরের বন্যার ভয়ার্ত রুপ।
আফতার আলীর মতো অনেকের চোখে স্বপ্ন হয়ে আসা ধরলা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পটি দূরাশায় পরিণত হচ্ছে। ৫৯৫ কোটি টাকার এই বৃহৎ প্রকল্পে গত এক বছরে মাত্র ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ফলে ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি এলাকায় কাজ শুরু করতে পারছেনা পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৩ মার্চ ‘কুড়িগ্রাম জেলার কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলাধীন ধরলা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ ডান ও বাম তীর সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৫৯৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটির বাস্তবায়নের মেয়াদ ১ মার্চ ২০২০ থেকে ৩০ জুন ২০২৩। প্রকল্পের আওতায় ধরলা নদীর বাম ও ডান তীরে ১৬ দশমিক ৮৪০ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ, ১৬ দশমিক ৬৬৫ কিলোমিটার বিকল্প বাঁধ নির্মাণ, বাম তীরে ১৭ দশমিক ৯০০ কিলোমিটার বাঁধ পুণরাকৃতিকরণ ও চারটি ঘাটলা নির্মাণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ ও অনুমোদনের অভাবে এ পর্যন্ত মাত্র ৪টি স্থানে ২৪৫ কোটি টাকার তীর সংরক্ষণ কাজের টেন্ডার করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুলবাড়ী উপজেলার সোনাইকাজীতে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে আড়াই কিলোমিটার, সদর উপজেলার মোঘলবাসায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে ৩ কিলোমিটার, বাংটুরঘাটে ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ কিলোমিটার ও হেমেরকুঠিতে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে তীর সংরক্ষণ কাজ। তবে কোথাও কাজ শুরু হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, বকেয়া পাওনা না পাওয়ায় বরাদ্দ কম থাকায় ঠিকাদাররা দ্রুত কাজ শুরু করতে অনাগ্রহী। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সাজু হার্ডওয়ারের এর স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজার রহমান সাজু জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে গত বছরের বাঁধ নির্মাণের ২ কোটি টাকার পাওনা রয়েছে। এবার নতুন প্রকল্পে কাজ শুরু করতে ঠিকাদারদের সমস্যা হচ্ছে। বকেয়া পরিশোধ হলে ঠিকাদাররা দ্রুত কাজ শুরু করতে পারতো।
এদিকে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে বিলম্ব হওয়ায় ফলে গত বছরের বন্যার মতো এবারেও কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙন তীব্র রুপ নিতে পারে। বিলীন হতে পারে কয়েকশ ঘরবাড়ি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, স্কুলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলাকাবাসী সুত্রে জানা গেছে, গত বছরে বন্যায় সদর উপজেলার সারডোবে একটি বিকল্প বাঁধের প্রায় ৪০০ মিটার অংশ ভেঙে ১০টি গ্রাম প্লাবিত ও শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে কয়েকটি গ্রামের মানুষ। বাঁধ সংস্কারসহ তীর সংরক্ষণ কাজের প্রকল্পের ডিজাইন পেতে বিলম্ব হয়েছে। ফলে টেন্ডার করতেও বিলম্ব হচ্ছে। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে বাঁধের বাকি অংশসহ পুরো গ্রাম বিলীন হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় বাস করা সারডোবের ভোলা মিয়া, রমজান, জায়েদুলসহ অনেকেই আশঙ্কা ঘর বাড়ি ভেঙে সড়কে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাজারহাটের কালুয়ার চরে গত বছর একটি স্কুল ও অর্ধশত পরিবারের ভিটেমাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আগামীতে গ্রামের বড় অংশ ভাঙনের কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কালুয়ারচরে বাঁধে ভাঙন শুরু হওয়ায় গত বছর জিও ব্যাগ দিয়ে কোনমতে ভাঙন ঠেকানো হয়। এবার স্থায়ী প্রতিরক্ষার কাজ শুরু না হলে ২০১৭ সালের মতো বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা রয়েছে। একই অবস্থা সদরের বাংটুরঘাট ও সিএন্ডবি ঘাট এলাকায়। দুটি স্থানেই বাঁধের অংশ বিশেষ ভেঙে গেছে। সদরের চর কৃষ্ণপুর গ্রামটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। গত বছর একটি স্কুলসহ শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয় এখানে। এবার বর্ষার আগে কাজ শুরু না হলে একটি বাজার, দুটি স্কুল, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক বিলীনের আশঙ্কা রয়েছে। একই অবস্থা মোঘলবাসা এলাকায়। গত বছর এখানে দেড় কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন শুরু হয়। সন্ন্যাসী মোড়ে বাঁধের কয়েক ফুটের মধ্যে চলে এসেছে নদী। এখানে স্কুল, বাজার, ইউপি ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হুমকিতে রয়েছে। চর শিতাইঝার ভাটলারপাড় এলাকায় দুটি স্কুল ও একটি রেগুলেটর ঝুঁকিতে রয়েছে। ভোগডাঙার জগমোহনের চর এলাকায় গত বছর ব্যাপক ভাঙনে বাঁধের অংশবিশেষসহ দেড় শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়। এখানে হুমকিতে রয়েছে বাঁধ, বাজার, পাকাসড়ক। ভাঙনের কবলে রয়েছে সদরের পাঁছগাছি ও রাজারহাটের জয়কুমর এলাকা। এসব এলাকায় বর্ষার আগে কাজ শুরু করতে না পারলে এসব এলাকায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আরিফুল ইসলাম জানান, কয়েকটি এলাকায় ইতোমধ্যে টেন্ডার হয়েছে। আরো কয়েকটি এলাকায় টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এবছর সব এলাকায় কাজ শেষ না হলেও জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রবণ এলাকায় ভাঙন ঠেকানো হবে। তীর প্রতিরক্ষার কাজটি শেষ হলে ধরলা পারের মানুষ নদীভাঙনের অভিষাপ থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাবেন।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!