প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় কর্মকতার্দের গাফিলতি ও দুনীর্তি

আব্দুল খালেক ফারুক :
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতার্দের গাফিলতি, কর্তব্যে অবহেলা ও দুনীর্তির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। ইতোমধ্যে উপজেলা শিক্ষা কর্মকতার্ আব্দুর রহমানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন বলে শিক্ষা বিভাগের কর্মকতার্রা দাবী করেছন। ভুরুঙ্গামারী নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মার বিরুদ্ধেও দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশি্ষ্ট সুত্রে জানা গেছে, শিক্ষা বোর্ডের নিয়মানুযায়ী পরীক্ষা শুরুর ৫/৭দিন আগে কেন্দ্র সচিব বা তার প্রতিনিধি এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের মাধ্যমে ট্রাংকে রক্ষিত প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের সাথে “প্রশ্নপত্রের চাহিদা” সঠিকভাবে যাচাইয়ের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। কোন গড়মিল থাকলে সাথে সাথে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে লিখিতভাবে জানাতে হবে। কিন্তু ইউএনও সেই কাজ না করে পরীক্ষার দুদিন আগে অথার্ৎ ১৩ সেপ্টেম্বর উপজেলা শিক্ষা কর্মকতার্কে প্রশ্নপত্র সটিং করে প্রতিবেদন দেবার নির্দেশ দেন। পরীক্ষা শুরুর পর থেকে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলেও আমলে নেননি ইউএনও দীপক কুমার।

গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মাকে শোকজ করেছেন জেলা প্রশাসক কুড়িগ্রাম। গত বুধবার তিন কর্মদিবসের সময় দিয়ে শোকজের জবাব দিতে বলা হয় ওই শোকজ পত্রে।
এই বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বিধি মোতাবেক ইউএনও পরীক্ষার ব্যাপারে চিঠি করেছেন। তারপরেও কোন গাফিলতি আছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইউএনওকে শোকজ করা হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,তাকে জবাব দিতে বলা হয়েছে। শোকজের জবাব পেলে পরবর্তী করনিয় ঠিক করা হবে।অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য শুক্রবার ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মার বাসায় গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করলে তিনি অসুস্থতার অজুহাতে সাক্ষাত দেননি।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় কার দায় কতটুকু
উপজেলা নিবার্হী অফিসার ছাড়াও উপজেলা শিক্ষা কর্মকতার্ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতার্দের গাফিলতি ও কারো কারো দুনীর্তির কারণে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে জানা গেছে। উপজেলা নিবার্হী অফিসার পরীক্ষার আগে উপজেলার ৬টি কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতার্ নিয়োগ করেন। এর মধ্যে নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরী, পল্লী উন্নয়ন অফিসার রায়হান হককে দায়িত্ব দেয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়,ভূরুঙ্গামারী থানায় প্রশ্ন বাছাই করার সময় নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান উপজেলা মাধ্যমিক অফিসার আব্দুর রহমানের সহায়তায় পরবতীর্ কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রের একটি করে খাম ঢুকিয়ে নেন এবং প্যাকেট সীলগালা করেন। তার ওপর স্বাক্ষর করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। বিভাগীয় তদন্তে আব্দুর রহমানের দুনীর্তি ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বলেন, বরখাস্ত হওয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমান বৃহস্পতিবার অসুস্থ হয়ে ভূরুঙ্গামারী হাসপাতালে ভর্তি হন। অবস্থার অবনতি হলে শুক্রবার তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমান বলেন, দুনীর্তি নয়, আমাকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমি বর্তমানে হসপিটালাইজড আছি এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।

এদিকে থানা থেকে পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে কেন্দ্র সচিবসহ প্রশ্নপত্র আনার ও পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নপত্রের খাম খুলে কক্ষগুলোতে বিলিবন্টন করেন ওই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই কর্মকতার্। এসময় বোর্ডের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পাঠানো প্রশ্নে পত্রের খাম গণনা করার নিয়ম থাকলেও তারা দায়িত্ব অবহেলা করে তা করেনি। তাদের উপস্থিতিতেই পরবতীর্ পরীক্ষার খামগুলো সরিয়ে ফেলা হলেও কীভাবে তা নজর এড়িয়ে গেল এ বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতার্ প্রশ্ন ফাঁসের মামলার বাদী উপজেলা মৎস্য কর্মকতার্ আদম মালিক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে জানান, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি তারা প্রথমে টের পাননি। তবে চারিদিকে কানাঘুষা শুনে এবং রাস্তায় হাঁটার সময় অনেকেই বিদ্রুপ করা শুরু করে, তখন বুঝতে পারেন। পরে উপজেলা নিবার্হী কর্মকতার্ ও পুলিশ কর্মকতার্ কেন্দ্র সচিবকে জিঙ্গাসাবাদ করলে তিনি প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করেন। মামলার বাদী হওয়ার কারণে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন, তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকতার্রা। ভুরুঙ্গামারী থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতার্দের গাফিলতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকলে মামলায় আসামী হতে পারেন যে কেউ।
তদন্ত কমিটির গোপনীয়তা
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তিন সদস্যের তদন্ত টিম দুদিনের তদন্ত শেষে আজ ফিরে গেছেন। বৃহস্পতিবার প্রফেসর দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর ফারাজ উদ্দিনের নেত্বত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি ভুরুঙ্গামারী ডাকবাংলো, থানা ও উপজেলা নিবার্হী অফিসারের কাযার্লয়ে দফায় দফায় তদন্ত কাজ পরিচালনা করেন। পরে শুক্রবার সকালে জেলা শিক্ষা অফিসারের কাযার্লয়ে গিয়ে বক্তব্য শুনে চলে যান। সাংবাদিকরা কয়েক দফায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা কোন বক্তব্য দেননি বরং চরম গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন।
পুলিশের বক্তব্য
প্র্শ্ন ফাঁসের সঙ্গে পুলিশের কোন গাফিলতি বা সংশ্লিষ্টতা আছে কীনা এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তবে ভূরুঙ্গামারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন এমস সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, পুলিশের কাজ ট্রেজারি থেকে স্কট দিয়ে প্রশ্ন আনা, স্কট দিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন নেয়া,স্কট দিয়ে উল্টরপত্র বোর্ডে স্কট দিয়ে পৌঁছে দেয়া ও সিলগালাকৃত ট্রাঙ্গ সংরক্ষণ করা। প্রশ্নপত্র বাছাই, বন্টনসহ কোন পযার্য়ে পুলিশের কোন অংশগ্রহনের সুযোগ নেই।
পরীক্ষার প্রস্তুতি কেন্দ্রে
নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় প্রধান শিক্ষকসহ ৬ জন কর্মকতার্ কর্মচারি গ্রেপ্তার হবার পর পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে চাপা আতংক ও হতাশা বিরাজ করছে। শুক্রবার দুপরে এই কেন্দ্রে গিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও আতংক দেখা গেছে।
তবে নব নিযুক্ত কেন্দ্রসচিব খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, শনিবার ইতিহাস ও ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং পরীক্ষাসহ পরবতীর্ সব পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বরখাস্তকৃত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমানের স্থলে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সহকারী শিক্ষা অফিসার সাজ্জাদ হোসেনকে। তিনি শুক্রবার দুপুরে কাজে যোগদানের সময় সাংবাদিকদের জানান, পরীক্ষার সব নিয়ম নীতি অনুসরণ করে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গস্খহন করা হবে। শিক্ষার্থীদের আতংকিত হবার কোন কারণ নেই।

Facebook Comments
Share
  •  
  •  
  •  
  •  
error: Encrypted Content!